পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

কথ্য বা লেখ্য— যে-রূপেই প্রকাশ হোক না কেন, সমস্ত উচ্চারণই উৎসে-বিকাশে-পরিণতিতে সামাজিক। বিপুল ও নিরবচ্ছিন্ন দ্বিবাচনিকতার প্রক্রিয়ায় মানুষের উচ্চারণ লক্ষ্যের দিকে ছুটে যায় এবং খুঁজে পায় ঈঙ্গিত পরিসর। এই প্রক্রিয়া জীবনের পক্ষে অপরিহার্য, তাই সক্রিয় ভাবে যারা তাতে যোগ দেয় কিংবা নিস্ক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে কেবল—নানা উচ্চারণের বহুমুখী বিদূরণে তারা প্রত্যেকে অনিবার্যভাবে সামাজিক প্রতাপ ও আধিপত্যের যুক্তিশৃঙ্খলায় সংযুক্ত হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিবেদনকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না, এই হলো বাখতিনের মৌলিক পাঠ। স্বভাবত এই সূত্র অনুযায়ী বাখতিনের নিজস্ব উচ্চারণকেও দেখতে হয় তাঁর সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে দ্বিবাচনিক সম্পর্কের বিন্যাসে। বস্তুত বাখতিনের মহাসূত্র হলো, সত্য দ্বিবাচনিক। যে-সমস্ত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমরা অন্যদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে চাই, তাদের সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য, শক্তি ও গুরুত্ব সর্বদা নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বাখতিনের উচ্চাবচ জীবন-বৃত্তান্তের দিকে যদি তাকাই, এই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাখতিন একে বলেন উচ্চারণের অনিবার্য যথাপ্রাপ্ত স্থিতি। সামাজিক জীবনের জটিল গ্রন্থি এবং দ্বন্দ্বময় ঐতিহাসিক সময় প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে স্বতন্ত্র করে দেয়। বাখতিনও এর ব্যতিক্রম নন।

দুই

 ক্যাটেরিনা ক্লার্ক ও মাইকেল হলকুইস্ট-এর অন্তর্দীপ্ত গবেষণার ফলে আমরা বাখতিনের বৌদ্ধিক জীবন সম্পর্কে যে-চমৎকার বইটি পেয়েছি (১৯৮৪), তার ফলে বাখতিন এবং তাঁর চিন্তাবৃত্ত সম্পর্কে পরবর্তী বিশ্লেষণী বিস্তারের পথ সুগম হয়েছে। এক জীবনে জন্ম জন্মান্তর ঘটে যাওয়ার কথা বাঙালি পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথের কাছে শুনেছেন। এই উচ্চারণকে নিছক ভাবুক কবির অতিরেক বলে ধরে নিতে পারেন অনেকেই। কিন্তু যখন লক্ষ করি, বাখতিনের নাটকীয় জীবনপ্রবাহে এই উচ্চারণ অনেকখানি সত্য হয়ে উঠেছিল—বিস্মিত না হয়ে পারি না। চীনা সমাজে বয়স্কজনেরা নাকি এই আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন, ‘আগ্রহ উদ্দীপক (অর্থাৎ ঘটনাসংকুল) সময়ে তোমাদের যেন বাঁচতে না হয়!’ অথচ বাখতিনকে বেঁচে থাকতে হয়েছিল ঠিক সেরকম সময়েরই আবর্তে যখন রুশদেশের সমাজ, বাস্তবতা, ভাবাদর্শ—সমস্ত ভূমিকম্প ও ঝড়ের যৌথ আলোড়নে উথাল-পাথাল হয়ে যাচ্ছিল। রাশিয়ায় যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটছিল, সেই ১৯১৭-তে বাখতিনের বয়স বাইশ; স্পষ্টত বিপ্লবের দিনগুলিতে তিনি এর অনিশ্চয়তা ও উত্তাপ, সংশয় ও স্বপ্ন—সব কিছুর শরিক হচ্ছিলেন। নতুন ধরনের পুনর্নির্মাণের উদ্দীপনাকে বোঝার জন্যে বিপুলভাবে আত্মবিনির্মাণও যে করতে হচ্ছিল তাঁকে, একথা অনুমান করা কঠিন নয়। তারপর এল গৃহযুদ্ধের দুরূহ দিনগুলি; সেই পর্ব শেষ হতে না হতেই দেখা দিল স্ট্যালিনবাদের প্রাথমিক পর্যায়। ত্রিশের দশকে নেমে এল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অন্ধকার এবং তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও জার্মান আক্রমণ। হিমযুদ্ধের পর্বে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা হলো প্রবলতর; স্ট্যালিন-পরবর্তী রাশিয়ায় ক্রুশ্চেভের নয়া জমানাও দেখলেন বাখতিন। আর, মৃত্যুর আগে, ব্রেজনেভের পর্যায়ে রুশ-সমাজে অবসাদের বিস্তারও তিনি দেখে

২৯