পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গেছেন। এত সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনের পর্ব থেকে পর্বান্তরে পৌঁছানো অবিস্মরণীয়। সুতরাং বাখতিনের উচ্চারণকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ক্রমিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ না-করে উপায় নেই। এ তাঁর গভীর উপলব্ধিতে অর্জিত আবিষ্কার যে, প্রতিটি তাৎপর্যকে আত্মস্থ করতে হয় নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর ক্রমিক বিবর্তনকে বোঝার জন্যেও চাই সামাজিক ইতিহাসের নিবিড় পরিচয়, প্রেক্ষিতের সঙ্গে সত্যের সম্পর্কের গুরুত্ব বিচার। তাঁর চেয়ে বেশি আগ্রহ-উদ্দীপক, ঘটনাসংকুল সময়ে কে বেঁচেছিলেন আর! তাঁর মতো এত বিচিত্র বিবর্তনের মধ্য দিয়েও আর কাউকে যেতে হয়নি।

 বিশের দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার বৌদ্ধিক সমাজে বাখতিন ছিলেন নিতান্ত প্রান্তিক ব্যক্তিত্ব; কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র কয়েকজন সহযোগী বন্ধু ও গুণমুগ্ধ জনের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম মৌল নির্যাস—‘প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা’ আর ‘অস্তিত্ব কখনো স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়,’ ‘অস্তিত্বকে অপর সত্তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়’—এসব জীবনের দুরূহ পর্বের উপলব্ধি থেকেই আহরণ করেছিলেন তিনি। বস্তুত জীবনকে যে বাখতিন ‘উপন্যাসত্ব’ বলেন এবং বারবার শৈল্পিক প্রতিবেদন ও জীবনের সন্দর্ভকে অভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, এর সূত্রও রয়েছে এখানে। ত্রিশের দশকের প্রথম কয়েক বছর তাঁকে কাজাখাস্তানে রাজনৈতিক কারণে নির্বাসন ভোগ করতে হয়: ১৯৩৬-৩৭ সাল নাগাদ সামান্য সময়ের জন্যে তিনি মোর্দোভিয়ায় একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। অর্থাৎ এই দশকটা তাঁকে কাটাতে হয় বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতায়। এর পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত বাখতিন মস্কোর নিকটবর্তী একটি ছোট্ট শহরে দিন কাটিয়েছেন। সম্ভবত এইজন্যে রুশ বুদ্ধিজীবীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তিনি এড়াতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পরে অবশ্য তিনি মোর্দোভিয়ায় ফিরে যান এবং ১৯৬১-তে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত শিক্ষকতাই ছিল তাঁর জীবিকা। এই উথাল-পাথালের মধ্যেও বাখতিন কিন্তু কখনো বৌদ্ধিক জীবনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হননি। লাগাতার তিনি লিখে গেছেন যদিও তাদের খুব কম অংশই ছাপা হয়েছে। ১৯১৯ থেকে ১৯২৯-এর মধ্যে একটি অখ্যাত সংবাদপত্রে ছোট্ট নিবন্ধ ছাপানো ছাড়া স্বনামে তিনি কিছুই প্রকাশ করেননি। সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়ায় বিশেষ পরিস্থিতি এবং তাঁর অবস্থানগত জটিলতার জন্যে অনিবার্য আড়াল তাঁকে তৈরি করতে হয়েছিল। এই পর্বে ঘনিষ্ঠ বন্ধুজনদের নাম তিনি ব্যবহার করেছেন যাতে রচনা প্রকাশে কোনো অসুবিধা না হয়। অবশ্য এতে বাংলা সাহিত্যের ‘চণ্ডীদাস-সমস্যা’র মতো, কিংবা তার চেয়ে ঢের বেশি জটিল, ‘বাখতিন-সমস্যা’ তৈরি হয়ে গেছে এবং বিশেষজ্ঞরা পুরোপুরি দুটি দিকে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

 এ বিষয়ে আরো কিছু বলার আগে বাখতিন সংক্রান্ত অন্যান্য জরুরি তথ্যের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়ায় বাখতিন কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষে দু’তিন জন নাছোড়বান্দা গবেষকের কল্যাণে যেন মৃত্যুর দূরত্ব থেকে ফিরে এলেন তিনি জীবনে। পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এধরনের পুনর্বাসন, বলা ভালো নবজন্ম গ্রহণ, নিতান্ত বিরল ঘটনা। এরপর যা ঘটল, তার মধ্যে

৩০