পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আসলে সমান্তরালতার বোধ আর, সমান্তরালতা হলো অপরতার উপলব্ধি। এই জগতে কেউই নিজে-নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জগৎ ও জীবন সত্য হয়ে ওঠে শুধুমাত্র অপর সত্তার প্রতীতিতে। এমন কোনো উচ্চারণ নেই যা বৃন্তহীন পুষ্পের মতো নিজের মধ্যে জাগে এবং নিজের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। প্রতিটি উচ্চারণ অনিবার্যভাবে ধাবিত হয় সম্ভাব্য গ্রহীতা হিসেবে উপস্থিত বা অনুপস্থিত অপর সত্তার প্রতি। এইজন্যে কোনো বাচন একান্তিক নয় কখনো, প্রতিটি বাচন মর্মগত ভাবে দ্বিবাচনিক। যেহেতু জীবন এক প্রবহমান উপন্যাসত্বের অন্য নাম, উপন্যাসের সন্দর্ভও আদ্যন্ত দ্বিবাচনিক। সহযোগিতায় পূর্ণ হয় সত্তা আর সহযোগের অভাব তাকে রিক্ত করে কেবলই—এই সত্য যেমন একদিকে উন্মোচন করে উপন্যাস, তেমনি অন্যদিকে জীবনের সার্থকতা প্রমাণিত হয়। ব্যক্তিস্বর ও সামাজিক স্বরন্যাসের দ্বিবাচনিকতায়, বহু উচ্চারণের মধ্যে সঙ্গতির প্রয়াসে।

চার

তবু এই উপন্যাস-ভাবনাই মানুষের ভাববিশ্বে বাখতিনের একমাত্র অবদান নয়। বিশেষজ্ঞদের মোটামুটি সবাই লক্ষ করেছেন যে বাখতিনের প্রতিবেদনে রৈখিকতা বিরল। তাঁর জীবনীকারেরা জানিয়েছেন যে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি আবার জীবনের প্রথম পর্যায়ের চিন্তাবৃত্ত সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। আসল বাখতিন তত্ত্বের বিন্যাসে যেভাবে তাৎপর্য সন্ধান করেছেন, ঠিক একই ভাবে নিজের জীবনেও খুঁজেছেন। তাঁর কাছে অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসা আর জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা এক ও অভিন্ন হয়ে পড়েছিল। দ্বিবাচনিকতা যেহেতু তাঁর কাছে অস্তিত্বের সারাৎসার, সব-খোলো-চাবির মতো এই পরাতত্ত্বকে তিনি ব্যবহার করেছেন। বাখতিনের চিন্তাধারা অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি বহমান কালের মাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বর্তমানের একক মুহুর্ত বা অবস্থান তাঁর কাছে যথেষ্ট নয় কখনো। বাখতিন সেই দ্বিবাচনিক জগতের অধিবাসী যেখানে সার্বিক জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি নিজের পথে কেউ কখনো বিকশিত হতে পারে। না। প্রতিনিয়ত আমাদের অজস্র অপর সত্তার সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়, দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে যুক্ত হতে হয়। এমনকি নিজেরই সঙ্গে নিজের ব্যবধান তৈরি হয় কখনো কখনো; সেইসব মুহূর্তে নিজেরই মধ্যে অনুভব করি সত্তা ও অপরতার দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া।

 অতএব নিবিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাখতিন-কথিত দ্বিবাচনিকতা আসলে সামাজিক অস্তিত্বের প্রাধান্যকে যথাপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করে নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিটি সম্পর্কই সামাজিক সম্পর্ক। কেননা প্রতিটি উচ্চারণই সামাজিক উচ্চারণ। এহেন দ্বিবাচনিক জগতে কোনো তাৎপর্য স্বতশ্চল ভাবে দেখা দেয় না; নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাকে অর্জন করে নিতে হয়। তার মানে, কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি শেষ হয়ে যায় না, ফুরিয়ে যায় না তাৎপর্য। দ্বিবাচনিকতার সীমা নেই কোথাও: এই অনুভূতি-নিবিড় উচ্চারণের সূত্রেই ঐতিহ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে সাম্প্রতিক আয়তনে। তেমনি ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনাও প্রতিফলিত হচ্ছে আজকের দর্পণে। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে যে-তাৎপর্য, তাকে চূড়ান্ত বলে ভাবার কোনো কারণ। নেই। পরবর্তী মুহূর্ত-পরম্পরায় বিস্তৃত জীবনের প্রতিবেদনে আবারও নতুন হয়ে উঠতে

৩৪