পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কাছাকাছি চলে আসেন। বিষয়টি অবশ্য এমন যা খুব সতর্ক ও অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ দাবি করে। এখানে তার অবকাশ নেই। তবে দুরূহ জ্ঞানতাত্ত্বিক বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, শব্দ নিছক জ্ঞানের আধার নয়: এই উপলব্ধি কীভাবে আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত করে, তা স্বতশ্চলভাবে স্পষ্ট নয়। বস্তুবিশ্বে গ্রথিত বলেই তো ভাষা কার্যকরী ও বার্তাবাহক হতে পারে; কিন্তু অনস্বীকার্য এই নির্ভরতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা কোথাও রয়ে যায় বলেই পরাভাষার অস্তিত্বও প্রাসঙ্গিক। হয়তো বস্তু-গ্রন্থনার অতিরেক থেকে সংক্রান্তির চেষ্টার মূলে রয়েছে এক ধরনের ক্ষতিপূরণ অর্জনের প্রবণতা; এ যেন যুগপৎ ভাষার নিজস্ব আত্মসমালোচনা ও আত্মদীপ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বয়ান গড়ে ওঠে চেতনা ও অবচেতনার, শাব্দিকতা ও নৈঃশব্দ্যের নিরবচ্ছিন্ন অন্তর্বয়নে। শুধু বস্তুর বহিরঙ্গ জ্ঞানে নয়, তাকে বুঝি বস্তস্বরূপের অনুভূতিতে। প্রতিবেদনের অবচেতন উপকরণ বা নিঃশব্দ পরিসর কি ভাষার শুদ্ধতার উৎস? জানার প্রক্রিয়ায় তবে কি রয়ে যায় অনতিক্রম্য অশুদ্ধতার ছায়া? এইসব কূট প্রশ্নের সহজ মীমাংসা নেই কোনো। তাছাড়া কেবলমাত্র দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের কাছে যাব না মীমাংসার জন্যে; যেতে হবে কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিকদের কাছে। তাদের সৃষ্টিশীল ভাষাচেতনা থেকে সম্ভাব্য মীমাংসাসূত্র খোঁজার জন্যে।

দুই

 বাচনের পরিধি ও কার্যকারিতা নিয়ে যে-সমস্ত সূক্ষ্ম ও জটিল বিতর্ক হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে এখানে স্মরণ করছি: ‘It had to be either made transparent to the forms of knowledge, or thrust down into the contents of the un-conscious.’ (প্রাগুক্ত: ২২৯)। ভাষার কার্যকারিতায় এই যে দ্বিমেরু-বিষম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হলো, তা থেকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বতাত্ত্বিক প্রবণতারও ধারণা তৈরি করে নেওয়া যায়। স্বচ্ছ প্রকাশমাধ্যম হিসেবে ভাষা কি কেবল জ্ঞানের অভিব্যক্তির পক্ষে সহায়ক হবে? একসময় তাহলে তা যান্ত্রিক উপস্থাপন রীতিতে শৃঙ্খলিত হয়ে নির্দিষ্ট আকল্পের বাহক মাত্র হয়ে পড়বে। একক বাচন ও সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ যেহেতু অক্ষুন্ন থাকে, সময় ও পরিসরের নতুন গ্রন্থনায় পুরোনো আকল্পগুলি বিনির্মিত হতে বাধ্য। একদিকে বিধিবিন্যাসের রুদ্ধতা এবং অন্যদিকে রূপান্তরের অনিবার্য প্রেরণা, এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ভাষার গভীরে জন্ম নেয় ‘a whole landscape of shadow’ (তদেব: ৩২৬)। এই ছায়া-প্রপঞ্চের তাড়নাতেই কি পরাভাষার উন্মেষ সম্ভব হয়? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য মীমাংসা খুঁজতে গিয়ে ভাষাকেই আশ্রয় করতে হয় আবার। ভাষার আলোয় দেখতে হয় ভাষার বাহিরকেও। ‘বাহির’ বলতে বোঝাতে চাইছি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গগুলিকে। একথা না লিখলেও চলে যে, এইসব অনুষঙ্গ অনবরত বদলে যাচ্ছে; কখনো সূক্ষ্ম আর কখনো প্রকটভাবে। তাদের চাপ তৈরি হচ্ছে ভাষারই অন্দরমহলে। লক্ষ করলেই বুঝব, অন্তর ও বাহিরের সম্পর্ক বিন্যাসে পরিবর্তন যথার্থই অভ্যাসের ধারাবাহিকতায় বড়ো বড়ো ছেদ ঘটিয়ে দিচ্ছে। তবু ভাষা নিজেরই গভীরে নতুন দিক-নির্ণয়ের চেতনা আবিষ্কার করে নেয়।

 ভাষা প্রতিটি মুহুর্তেই ছেদ ও ধারাবাহিকতার মধ্যে নতুন সেতু রচনার কৃৎকৌশল খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যায়। এক মুহুর্ত থেকে অন্যমুহুর্তের দিকে বয়ে যেতে-যেতে একদিকে নিজের সামাজিকভাবে নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাবকে মান্যতা দেয় ভাষা, অন্যদিকে নতুন বার্তার

৪৫