পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দ্বিরালাপের বহুরৈখিকতাকে অনুধাবন করতে হবে আগে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে। বাখতিন-কথিত আরো একটি কেন্দ্রীয় ভাববীজের কথাও। তা হলো সমান্তরাল পার্থক্য বা ‘simultaneous differences’ সম্পর্কিত। সত্তা যেহেতু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় কখনো, সত্তার উচ্চারণও সহযোগী অপর সত্তার মুখাপেক্ষী। উচ্চারণ আসলে নিত্যনবায়মান সেতু যা সত্তাকে অপরের সঙ্গে সম্পূক্ত করে। অস্তিত্বগত ভিন্নতার জন্যে এই দুটি স্থিতির বীক্ষণে যে দ্বিমেরু-বিষমতা থাকে, তাদের মৌল স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার না করেও উচ্চারণ তাদের মিলিয়ে দেয় আশ্চর্য সমান্তরালতায়। অভিব্যক্ত ও অনভিব্যক্ত বাচনের এই পার্থক্য ও সমান্তরালতা সবচেয়ে সার্থকভাবে কবিতায় ধরা পড়ে। অন্যভাবে বলা যায়, এই হলো কবিতার ঈপ্সিত দ্বিবাচনিক প্রকরণ যাকে কেউ কেউ শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের যুগলবন্দি বলেও বর্ণনা করেন।

 সার্থক ছোটগল্পের বয়ানেও উচ্চারণের এই সম্বোধ্যমানতা স্পষ্ট। প্রসঙ্গ-নিরপেক্ষভাবে কোনো-একটি শব্দের যত মূল্যই থাক বা স্বয়ংপ্রভ বলে তাকে যত মান্যতাই দিই—নিছক আত্মগত নিরিখে তার প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। নিরুচ্চার ও সোচ্চারের সম্পর্ক যখন বিশ্লেষণ করি, বাচনিক নির্মিতির কৃৎকৌশল ও অন্তঃসার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করে নিতে পারি। অর্থাৎ যা কথিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, উচ্চারণ তা নয়; উচ্চারণ হলো কথিত ও অকথিতের অন্যোন্যসম্পূক্ত সমগ্রতা। কী জীবনে কী শিল্পিত পাঠকৃতিতে অজস্র উচ্চারণে গ্রথিত প্রতিবেদন থেকে আমরা ঐ সমগ্রতাই আশা করি। বলা ভালো, সমগ্রতার প্রতি আভিমুখ্য ও সক্রিয়তা কাঙ্ক্ষিত বলেই সম্বোধক নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্বোধিতকে খোঁজে। সম্বোধ্যমানতা যতক্ষণ অক্ষুণ্ণ থাকছে, ততক্ষণই সৃষ্টিশীলতা। প্রতিবেদন তাই অনবরত পরিস্থিতি নির্মাণ করে; সময় ও পরিসরে ক্রিয়াত্মক হয়ে শেষ পর্যন্ত ‘হাসতে হাসতে হাঁস হলো’-র মতো নিজেই হয়ে ওঠে বিশিষ্ট বাচনিক পরিস্থিতি। বাখতিন অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসায় যথাপ্রাপ্ত স্থিতি বা situatedness-এর ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতিবেদনকে ঐ অস্তিত্ববোধের সূত্রে বুঝে নিতে হবে আমাদের। এই স্থিতিতে যুগপৎ সত্তা ও বস্তুবিশ্বের বিভিন্ন স্তর নিজেদের সমান্তরালতা ও পার্থক্য নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উচ্চারণের মধ্যে দেখা যায় অজস্র বিচ্ছুরণ। এই বিচ্ছুরণ সম্বোধক, সম্বোধিত ও অবলম্বিত বিষয় কিংবা বস্তুবিশ্বের মধ্যে বিশেষ ধরনের নাট্য-আবহ তৈরি করে। অস্তিত্বের বহুবাচনিক অন্তর্নাট্য ও মিথষ্ক্রিয়ায় যা কিছু কুশীলব হিসেবে যোগ দেয়, তাদের সমবায়ী স্থিতিতে সমস্ত উচ্চারণ জন্ম নেয়, জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত অধিস্থিতিতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চারণের নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকা সত্ত্বেও অবসান হয় না। অদূরবর্তী কোনো এক পুনরুজ্জীবনের মুহুর্তে তাৎপর্য আবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় বাচন আবার ফিরে পায় নবীন উৎস-মুহুর্ত।

তিন

বাখতিন নিবিড় কাব্যিক উচ্চারণে জানিয়েছেন, প্রতিটি তাৎপর্যই মূলত প্রকল্প; তাকে কেউ কখনো চূড়ান্ততায় রুদ্ধ করতে পারে না। একদিকে মানুষের অভিজ্ঞতায় কোনো অন্তিম কথা নেই, অন্য দিকে মানুষের জগতে এমন কিছুই নেই যাকে ‘absolutely dead’ (১৯৮৬:১৭০) বলা যায়। আর ‘Every meaning will have its home coming festival’

৪৭