পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপেক্ষিক, নিয়ত চলমান। সম্বোধক নয়, সম্বোধিত অপরতাই মুখ্য এবং তা কেবলই নির্মীয়মান। যাকে বলেছি সম্বোধক সত্তা, তাও মূলত ঐ সম্বোধিতের দ্বারা উদ্দীপিত। বাখতিনীয় সত্তা কখনও সম্পূর্ণ নয়, কেননা দ্বিবাচনিক ভাবেই তার অস্তিত্ব বিকশিত হতে পারে। আমাদের জিজ্ঞাসা ও মীমাংসার প্রত্যাশা যত রূপান্তরিত হয়, একদিকে পাল্‌টে যায় আমির স্বরূপ, অন্যদিকে যাবতীয় অপরতার সঙ্গে অস্মিতার সম্পর্কের নির্মিতি। একটু আগে যে পার্থক্য-প্রতীতির কথা লিখেছি, সত্তা ও অপরতার স্বাতন্ত্র্য তার প্রাথমিক ভিত্তি, অন্য সব পার্থক্য দাঁড়িয়ে আছে এর ওপর। বাখতিন-কথিত কৃত্যের জগৎ হলো অস্মিতা ও অপরতার মূর্ত নির্মিতি—প্রকরণগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈপরীত্যের অভিব্যক্তি। নির্মিতির ধরন আমাদের উপস্থিতি, অভিব্যক্তি ও অভিপ্রায়ের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। তলিয়ে ভাবলে দেখি, অপরতাই প্রকৃত নিয়ন্তা। গভীরতর অর্থে অপর পরিসর সত্তার বন্ধু; কেননা অপরতা আপাত-গ্রহীতা হলেও আসলে তা সত্তার রূপকার। অপর না থাকলে সত্তার প্রকাশ হত না। বাখতিনের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য নিবিড় অভিনিবেশ দাবি করে, ‘Dialogism celebrates alterity’ (১৯৮৪: ৬৫)। যত রূপান্তরিত হচ্ছি, তত আমার সত্তার গভীরে অন্তঃশায়ী সম্ভাবনা প্রসারিত হচ্ছে। এবং, তা ঘটছে অজস্র কৃত্যের মধ্য দিয়ে। তবু এ কেবল উদ্যমের প্রসার নয়, এ আসলে অস্তিত্বের নানা বৈকল্পিক স্থিতির প্রতিষ্ঠা। এ-সম্পর্কে বাখতিনের মন্তব্য লক্ষ করার মতো: ‘As the world needs my alterity to give it meaning, I need the authority of others to define, or author, myself.’ (তদেব)। সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে যে-সত্তা রয়েছে অস্তিত্বের কেন্দ্রে, জগতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে গেলে তাকে কখনো নিরেট ও রুদ্ধ হলে চলে না। সত্তার মুক্ত উপস্থিতি মানে তার অভিব্যক্তি কোনো-একটি নির্দিষ্ট ধরনের হবে না; নানা বিকল্পের মধ্যে বিচ্ছুরিত হবে তার নির্মিতি-প্রকরণ, সম্ভাব্য মীমাংসার দিকে যাত্রা। জগৎ যখন সত্তাকে চায়, ঐ মুক্ত স্বভাবের নিরিখ ব্যবহারের জন্যেই চায়। যত বেশি বিকল্প অবস্থানের দর্পণে জগৎ নিজের সঙ্গে সত্তার সম্পর্ককে প্রতিবিম্বিত দেখে, তত তার তাৎপর্য অর্জন হয়ে ওঠে সার্থক। আবার নিজের সত্তাকে রচনা বা সংজ্ঞায়িত করতে চাই যখন, সমস্ত অপরের অনুমোদন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আসলে অনুমোদন নয়, অভিজ্ঞান। কেননা অপর পরিসর ব্যাপ্ত রয়েছে সর্বত্র, তার বাইরে কিছুই নেই। সত্তার সঙ্গে অপরের বন্ধুতা স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত জীবন নিষ্ফল, নিষ্ক্রিয়।

 চিন্তাজীবনের সূচনাপর্বে রচিত হলেও ঐতিহাসিক কারণে ‘Art and Answerability’ এবং ‘Toward a Philosophy of the Act’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ইংরেজি-জানা দুনিয়ার কাছে বাখতিনীয় চিন্তাবিশ্ব বিপুল উৎসাহে পঠিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। বাখতিনের তত্ত্ব-প্রস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণাও দৃঢ় ভিত্তি পেয়ে গেছে। তাই তাঁর চিন্তাজীবনের সূচনাপর্বে রচিত এই দুটি যুগলবন্দি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে তাঁরই ভাবনার দর্পণে ভাববিশ্বের ক্রমিক উন্মোচন ও পুষ্পায়ন পুনঃপরীক্ষিত হওয়ার চমৎকার সুযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এতে কিছু কিছু সমস্যার দিকও আছে। কেননা ইতিমধ্যে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত বাখতিনীয় ভাববিশ্ব দ্বারা এই দুটি প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ প্রভাবিত হওয়াটা অনিবার্য। পূর্ব-নির্ধারিত

৫৯