পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 যেহেতু মানুষই শুধু জীবন ও বাচনের পাঠ নির্মাণ করতে পারে এবং সম্বোধিত সত্তার উদ্দেশে প্রেরিত বয়ানের দায়ও মানুষের পক্ষেই কেবল গ্রহণ করা সম্ভব—নির্মাণবায়ন প্রবণতাকে প্রতিস্পর্ধা জানানোর জন্যে বাখতিনীয় ভাবকল্পকে নতুন ভাবে কর্ষণ করা যেতে পারে। আজকের আধুনিকোত্তর অধিবাস্তব যখন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অভিনব উৎকর্ষকে ব্যবহার করে শুধু নিশ্চিহ্নায়নের তোড়ে সময় ও পরিসরের অনুষঙ্গকে অবান্তর করে দেওয়ার জন্যে, মানুষের সঙ্গে তার জগৎ-পরিবেশের সমস্ত সম্ভাব্য সম্পর্ক মুছে ফেলার জন্যে—বাখতিনের তত্ত্ব মানুষের নির্বাসন-আশঙ্কাকে প্রতিহত করতে পারে। সাম্প্রতিক উত্তর-মানবতন্ত্রী যুগে এই মানবিক নিষ্কর্ষ পুনঃপাঠ নিছক বৌদ্ধিক কৃত্য নয়; তা আসলে যুদ্ধের ঘোষণা। বস্তুত বাখতিনের আরেকটি মহাবাক্য যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এতে; সমস্ত তাৎপর্যই সংঘর্ষ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়। উদ্যম বা কৃত্য শুধু চিন্তা-অনুভূতি-অভিজ্ঞতার উপস্থাপনা মাত্র নয়, তাকে বুঝে নিতে হবে প্রত্যুত্তর হিসেবে। জগতের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ব্যক্তিসত্তা যখন নিজের জন্যে কোনো তাৎপর্য গড়ে নিতে চায়, তার প্রয়াসের প্রণালীবদ্ধ অভিব্যক্তি হলো ঐ উদ্যম। সুতরাং সামাজিক পরিস্থিতি থেকে উৎসারিত জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যে সত্তা নিজেকে যখন নির্মাণ করে, একই সূত্রে তার প্রত্যুত্তর-মূলক বয়ানও নির্মিত হয়ে যায়।

 সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক অনবরত বদলে যেতে-যেতে ব্যক্তিসত্তার জিজ্ঞাসাকেও সংগঠিত করে। নির্মিতি-সংলগ্ন বিভিন্ন সম্পর্ক-বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সত্তা নিজেকে চিনে নেয় এবং নিজস্ব অস্তিত্বের তাৎপর্যও সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টিতে কীভাবে অপরিহার্য অপর সত্তার উপস্থিতি, তা আগেই আলোচিত হয়েছে। এখানে শুধু একথাই বলতে পারি যে উদ্ধত প্রতাপের যাবতীয় রুদ্ধতার চক্রান্ত প্রতিহত হয় নির্মাণের মানবিক দ্বিবাচনিকতায়। এই সূত্রে যত চিহ্নায়ক বা রূপকের কথা ভাবি না কেন, তা সক্রিয় পর্যবেক্ষকের নিজস্ব উপস্থাপনার তাগিদে রচিত হয়। চেতনার পক্ষে অজ্ঞেয় কিছু নেই; আড়াল তৈরি হয় দৃষ্টিক্ষীণতায়, ধারণার একবাচনিকতায়। দেখা মানে হওয়া—চিরাগত অধিবিদ্যার এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে বাখতিন আমাদের জানিয়েছেন: কোনো বস্তুর প্রতীতি সর্বদা পর্যবেক্ষকের সঙ্গে সমান্তরাল। অর্থাৎ কোনো কিছু জানার মানে হলো তাকে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা অর্জন।

 সুতরাং কোনো উদ্যম বা কৃত্য জীবনে ও পাঠকৃতিতে সর্বদা দৃষ্টির ঘোষণা, দৃষ্টির নির্মিতিও। জীবন বা বয়ানকে আধিপত্যবাদ যখন রুদ্ধ করতে চায়, অস্তিত্বের প্রকরণ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক অপরতার পরিসরও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। বাখতিনীয় ভাবকল্প অনুযায়ী সত্তা যখন ‘দৃষ্টির উদ্বৃত্ত’-তে আস্থা প্রকাশ করে, প্রতাপের একবাচনিক স্থিতি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। ‘দৃষ্টির উদ্বৃত্ত’ মানেই সীমাতিযায়ী অবস্থানে বিশ্বাস ঘোষণা। বহির্জগৎ সম্পর্কে সচেতন মানুষই কেবল তেমন দৃষ্টির অধিকারী। আর, উদ্বৃত্তে বিশ্বাসী হওয়ার ফলে মানবিক পরিসরে একাধিপত্যের আশঙ্কাতেও বিচলিত হয় না পর্যবেক্ষক সত্তা। জীবনের নির্মিতি-প্রকল্প পরাভূত হয় না। সত্তাকে যেহেতু প্রকল্প হিসেবে ভেবে নিতে হয়, তার পুনর্নবায়ন অক্ষুণ্ণ থাকে সর্বদা। প্রতিটি সত্তাই যেহেতু সহযোগী সত্তা অর্থাৎ সত্তার ধারণা অনিবার্য ও নিষ্কর্ষগত ভাবে সামাজিক, সত্তার বয়ান নির্মাণে পারস্পরিক সহযোেগ অব্যাহত থাকে। সর্বত্র ব্যাপ্ত

৬৩