পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পেয়ে যান। কিন্তু মস্কো থেকে চারশ’ মাইল পূর্বের সেই ছোট্ট শহরেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে তিনি নিস্তার পেলেন না। এক বছর চাকরি করার পরে ১৯৩৭ সালে যখন আবার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হলো, পদত্যাগ করে বাখতিন চলে এলেন মস্কোর উত্তরে সাভেলোভো নামে ছোট্ট শহরে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তিনি ওখানেই ছিলেন। কিন্তু বারবার স্থান পরিবর্তন করার ফলে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়াতে বহির্জগতের কাছে বাখতিন কার্যত মৃত হয়ে পড়লেন। তাঁর অস্তিত্বও ধীরে ধীরে বর্তমানের পরিধি থেকে মুছে গেল। এর কারণ, সহযোগী সত্তার অভাবে কোনো সত্তা কখনো বিকশিত হয় না; হয়ে ওঠার নিরন্তর প্রক্রিয়া যেহেতু স্বভাবে সামাজিক, এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রসঙ্গচ্যুত সত্যভ্রমের আস্ফালন অনিবার্য। গতি জীবনেরই প্রকাশ এবং তা দ্বিবাচনিকতার নামান্তর; নিঃসঙ্গ তা তেমনি একবাচনিক এবং স্থবিরতার মধ্য দিয়ে আত্ম-অবলুপ্তির সূচক। বাখতিনের জীবনে তথ্য ও তত্ত্বের যুগলবন্দি অবিস্মরণীয়। তাই দেখি, তাঁর উচ্চারণ গড়ে ওঠে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যখন তাঁর জীবিকা অনিশ্চিত এবং জীবন অস্থির, সে-সময় নিত্যনতুন মননের বয়ন চলেছে; আবার যখন তিনি মোটামুটি স্থিতিশীল চাকরি করছেন—সে-সময় তাঁর রচনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বিল্‌ডুঙ্গ্‌স্‌রোমান বা শিক্ষাকেন্দ্রিক উপন্যাস সম্পর্কিত বইয়ে কেন্দ্রীয় সত্তার ধারাবাহিক অগ্রগতির কথা যিনি বলেন, তিনিই আবার চরম খামখেয়ালির পরিচয় দিয়ে সিগারেটের কাগজ হিসেবে ব্যবহার করে খসড়া পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ পুড়িয়ে ফেলেন। এই বইয়ের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি প্রকাশন-সংস্থার ঘরবাড়ি সহ ধ্বংস হয়ে যায় জার্মান হানাদারদের বোমা-বর্ষণে। বারবার নতুন হয়ে-ওঠা প্রতিবেদনের কথা যিনি বলেছেন, তাঁর জীবনেও পুনর্নির্মাণের পালা এসেছে অসংখ্যবার।

 যুদ্ধের পর সারান্‌স্ক শহরের চাকরিটা ফিরে পেয়েছিলেন বাখতিন। ১৯৬১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি সক্রিয় শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বহুস্বরিক জীবনের তাৎপর্য কীভাবে ক্রমশ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, তার একটা সংকেত যেন পাওয়া যাচ্ছে এখানে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় বিভিন্ন বাক্‌মাধ্যম (speech-genres) সম্পর্কে চমৎকার দীর্ঘ নিবন্ধ লেখা ছাড়া নতুন কোনো তাত্ত্বিক প্রসঙ্গের অবতারণা তিনি করেননি। ১৯৫২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রির বদলে বাখতিনকে ক্যাণ্ডিডেট্‌স ডিগ্রি দেওয়া হয়, তাও দীর্ঘ টালবাহানার পরে। ১৯৬০ সালে মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটের কয়েকজন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গবেষক বাখতিনকে আশ্চর্যজনক ভাবে পুনরাবিষ্কার করেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের মহাফেজখানায় তাঁরা ডস্টয়েভস্কি সম্পর্কে বাখতিনের বইটি দেখতে পান এবং তার কিছুদিন পরে রাবেলে বিষয়ক অভিসন্দর্ভও খুঁজে পান। প্রথম তাঁরা লেখককে মৃত বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর কিছু কিছু সূত্রে জানতে পারেন, বাখতিন তখনও জীবিত; স্বভাবত, গভীর কৌতুহলে তাঁরা এই আশ্চর্য তাত্ত্বিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর যা ঘটল, তা যেন আলাদিনের মায়াপ্রদীপের কাহিনি। বহু বাধা পেরিয়ে এঁদেরই চেষ্টায় ১৯৬৫ সালে রাবেলে ও তাঁর জগৎ বইটি প্রকাশিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে বিদগ্ধজনের মধ্যে

৭৬