পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দিল; অতি দ্রুত বাখতিন সোভিয়েত রাশিয়ার বৌদ্ধিক মহলে কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন। তরুণ বয়সের মতো প্রবীণ বয়সেও তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল নতুন ভাবমণ্ডল। ১৯৭৫ সালের ৭ মার্চ তাঁর কায়িক মৃত্যু হওয়ার পরেও বাখতিন-ভাবমণ্ডল ক্রমশ প্রসারিত হলো। প্রমাণিত হলো, জীবনচক্র আবর্তিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাৎপর্যের প্রতীতিও ফিরে আসে নদীর জলের মতো। কোনো কিছুই একেবারে হারিয়ে যায় না; একদিন-না-একদিন সব কিছু ফিরে যায় উৎসে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরবর্তী বারো বছরে গড়ে-ওঠা বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের আবহ হিসেবে প্রকট ছিল নতুন জীবনস্বপ্ন, নবনির্মাণের উত্তাপ, ভাবাদর্শের শক্তি ও লাবণ্য। অন্যদিকে, স্ট্যালিন-পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিথিলতার পর্বে নতুন ভাবে যখন চিন্তাবৃত্ত গড়ে উঠেছিল—তার মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায়ে চল্লিশ বছর। সুতরাং এই নবায়ন আসলে সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ। তবুও, তাৎপর্য-সন্ধানের প্রয়াস যে বৃত্তাকার পথে ফিরে এল নবায়িত দিশা নিয়ে—এটাই লক্ষণীয়।

 সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলি যখন সংকলিত হয়ে ছাপা হতে লাগল, বাখতিনের অসামান্য জীবন ও মননের দ্বিবাচনিকতা থেকে অর্থ খোঁজার প্রয়াসও শুরু হলো। বিচ্ছেদ ও ধারাবাহিকতার দ্বন্দ্ব পর্ব থেকে পর্বান্তরে কত বিচিত্র ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তাদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উত্থাপিত হলো। আগেই লিখেছি, ভোলোশিনোভ ও মেডভেডেভের সঙ্গে বাখতিনের নাম জড়িয়ে যাওয়াতে জটিল বিতর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। বিশের দশকের শেষে এবং ত্রিশের দশকের গোড়ায় মেডভেডেভ, বিশেষত সাংবাদিক ও প্রকাশন-সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে, লেনিনগ্রাদে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। আর, বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের সক্রিয় সদস্য ও তত্ত্বজিজ্ঞাসু হিসেবে ভোলোশিনোভও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের নামে যেসব বই বেরিয়েছিল, তার সঙ্গে ত্রিশের দশকে বাখতিন-রচিত অপ্রকাশিত নিবন্ধগুলির যৌক্তিক সাযুজ্য খুব প্রকট। এবং, এই তথ্যও খুব লক্ষণীয় যে মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভের বক্তব্যে মার্ক্সীয় ভাবাদর্শ ও বাচন নিয়ন্তা ভূমিকা নিয়েছে। তুলনামূলক ভাবে বাখতিনের স্বনামে রচিত প্রতিবেদনগুলিতে এই ভূমিকা আভাসিত; তবে একে গৌণ বলা যায় না। কারণ, বেশ কিছু মৌলিক ভাবকল্পের ক্ষেত্রে তিনি নিঃসন্দেহে মার্ক্সীয় চেতনায় প্রেরণার উৎস খুঁজে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে, ভোলোশিনোভ, মেডভেডেভ ও বাখতিন ঐতিহাসিক বাস্তবের দ্বারা নির্ধারিত এমন ত্রিস্রোত অস্তিত্ব—যাদের আপাত-ভিন্নতা সত্ত্বেও ভাবাদর্শের ঐক্য ও সংহতি অনস্বীকার্য। বাখতিন মার্ক্সবাদী ছিলেন কি ছিলেন না—এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। গভীর অন্তর্বৃত ঐক্যের ভিত্তিতে প্রাগুক্ত ত্রিস্রোত অস্তিত্বকে যদি এক ও অভিন্ন সত্যোপলব্ধির বিচ্ছুরণ বলে বুঝতে পারি, তাহলে একদিকে বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের বিশিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক অবচেতনা যেমন স্পষ্ট হয় তেমনি বিতর্কিত বইগুলির লেখকসত্তা সম্পর্কিত সমস্যাও তত পীড়িত করে না। আমাদের শুধু লক্ষ করতে হবে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বাখতিন যেসব নতুন আকল্প প্রস্তাব করেছেন কিংবা ভাষা-সাহিত্য-সমাজ-নন্দন সম্পর্কে যেভাবে উদ্ভাসনী আলো দিয়ে নতুন তত্ত্ববিশ্বের আদল গড়ে তুলেছেন—তাতে মার্ক্সবাদের সৃজনশীল পুনর্বিন্যাস হচ্ছে কিনা।

৭৭