পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সময় ও পরিসরের ধারণা যথাপ্রাপ্ত জগৎ থেকে নিষ্পন্ন হয় না কখনো। চেতনা মানে অপরতার প্রত্যয়, একথা বলেছেন বাখতিন। চিন্তার নব্য-কাণ্টীয় প্রকরণ দিয়ে তিনি সত্তা ও অপরের দ্বিবাচনিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। নিঃসন্দেহে তাঁর ভাবনার নির্যাস মার্ক্সীয় দ্বন্দ্ববাদের মৌল স্বরূপে নিষ্ণাত।

 সত্তা সম্পর্কে আমাদের অনুভব কিংবা অপর ব্যক্তিদের অপরতা সম্পর্কে আমাদের অনুভব পারস্পরিক অন্বয় ও অনন্বয়ের যে-বয়ন তৈরি করে—সেখানেই বাখতিনের জ্ঞানতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্ব আধারিত। জীবনে ও শিল্পে তাৎপর্যের অন্তর্বস্তু ও প্রকরণ স্বভাবত গড়ে ওঠে একই প্রক্রিয়ায়। যেহেতু সম্পর্কে সংলগ্নতা না কেবল—ব্যবধানও থাকে, সেতু নানাভাবে গড়ে ওঠে। অন্তত সেতুর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না কখনো। সূক্ষ্মভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক ও নান্দনিক সমস্যাগুলি পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষায় যেমন সমস্ত একটি অভিন্ন বস্তুতান্ত্রিক ঐক্যে বিধৃত, তেমনি বাখতিনের বহুস্বরিক যুক্তি-শৃঙ্খলায় আপাত-ভিন্ন অস্তিত্ব সমান্তরাল অবস্থানের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ঐক্যপ্রতীতির সম্ভাবনাকে কর্ষণ করেছে। দীর্ঘ চিন্তাজীবন জুড়ে তিনি এই মৌল আকল্পকে অনুসরণ করে গেছেন: ‘artistic form and meaning emerge betwen people’ (তদেব: ১৩)। শৈল্পিক প্রকরণ ও তাৎপর্য যদি জনসাধারণের পারস্পরিক বিনিময়ের প্রভাব থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে আধার ও আধেয়ের বহুমুখী দ্বিবাচনিকতা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিত আগাগোড়া তাঁর ভাববিশ্বে অনুসৃত হয়েছে। দার্শনিক ও নৈতিক উপাদানের সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সর্বদা তাঁর নজরে পড়ে বলে বিমূর্তায়নের প্রতি তত্ত্ববিদদের স্বাভাবিক ঝোঁককে তিনি অনেকখানি এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। সাহিত্যতাত্ত্বিক আলোচনায় চেতনার ঐতিহাসিক ভিত্তিকে তিনি কখনো ভুলে যাননি। বস্তুত বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা সর্বতোভাবে সামাজিক চরিত্রসম্পন্ন এবং লোকায়ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। যাঁরা শ্লেষের ভঙ্গিতে ও আত্মপ্রতারণার তাগিদে বলেন, ১৯১৭ সালের পরে ‘সরকারি বৌদ্ধিক অবস্থান’ (অর্থাৎ মার্ক্সীয় চেতনা) এড়িয়ে চলা বাখতিনের পক্ষে অসম্ভব ছিল—তাঁরা আসলে তাঁর জীবনব্যাপ্ত সত্যনিষ্ঠাকে অবমাননা করেন। এঁদের এইসব কথাবার্তা প্রতিভাবাদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এঁরা প্রমাণ করেন যে চোখ থাকলেও সবাই দৃষ্টিমান হয় না। তাঁরা যা দেখতে চেয়েছেন তা-ই দেখেছেন। মার্ক্সবাদের মধ্যে তাই এঁরা কেবলই খুঁজে পান ‘monolithic orthodoxy’ এবং পরস্পর-বিরোধী প্রবণতার সমন্বয়। এমনকি, তাঁদের ধৃষ্টতা এই বলে সীমা ছাড়িয়ে যায় যে মার্ক্সবাদ নাকি আদৌ রুশ সমাজতন্ত্রের বৈপ্লবিক চালিকাশক্তি নয় (তদেব: ৩৯৪)। ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করার এই নবার্জিত ঔদ্ধত্য এঁরা পেয়েছেন বিশ্বপুঁজিবাদের রুশ ‘মিত্র’দের মধ্যে যারা আশির দশকের শেষে অকল্পনীয় অন্তর্ঘাত করে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। অতএব বাখতিনের ভাববিশ্বেও তাঁরা একই ধরনের প্রতিবৈপ্লবিক অন্তর্ঘাত করার জন্যে তাঁর তত্ত্ব থেকে মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের সমস্ত সম্ভাবনাকে মুছে ফেলতে তৎপর।


পাঁচ

নব্বইয়ের দশকের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখছি, গত কয়েক বছর থেকে পৃথিবী জুড়ে চলছে তত্ত্ব-সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া ঔপনিবেশিক কৃৎকৌশলের তাণ্ডব। ইতিহাসের

৮০