পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

too. Everything ideological possesses semiotic value.’ (তদেব: ১০)। এই মন্তব্যের শেষ দুটি বাক্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ভাবাদর্শহীন কোনো চিহ্নায়ক হয় না বলে সময় ও পরিসরের অনুষঙ্গ ছাড়া তার তাৎপর্যের প্রতীতিও কখনো হতে পারে না। ভাষার অন্তর্বর্তী বহুস্বরিক সম্ভাবনাকে লেখক সর্বদা প্রত্যক্ষ করেছেন বর্গবিভাজিত সমাজের দর্পণে, ভাবাদর্শের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী প্রেক্ষিতে এবং সর্বোপরি সত্তা ও অপরতার দ্বিবাচনিক আয়তনে। ভাষার সামাজিক চরিত্রই চিহ্নায়কের নান্দনিক মাত্রা নির্ধারণ করে এবং সেই সূত্রে গ্রথিত হয়ে পড়ে প্রতিবেদনের পরিসরও। কোনো উচ্চারণ যখন অপর উচ্চারণের সীমানাকে ছোঁয়, তখনই বাচনিক মিথষ্ক্রিয়ার সূচনা হয়। সেই বিন্দুতে জীবনও সচল হয়ে ওঠে। জন্ম নেয় উপন্যাসের নীহারিকাপুঞ্জ। সুতরাং গভীর অন্তর্বৃত যুক্তিশৃঙ্খলায় মেডভেডেভ/বাখতিন ও ভোলোশিনোভ/বাখতিন পরিণততর বাখতিনের মননক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং মার্ক্সীয় চেতনার পরিসর ধারাবাহিক ভাবে পরিশীলিত হয়ে তাঁর অণুবিশ্বকে গড়ে তুলেছে—এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয় নিতে পারি আমরা। এই পরিপ্রেক্ষায় একক ও সামূহিক বাচনের দ্বিবাচনিকতায় সংগঠিত প্রতিবেদনের নান্দনিক ও সামাজিক তাৎপর্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আরো। কিন্তু এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।


ছয়

রাবেলে ও তাঁর জগৎ, ডস্টয়েভস্কির নন্দন-বিষয়ক সমস্যাবলী, দ্বিবাচনিক কল্পনা, বাচন-মাধ্যম ও অন্যান্য পরবর্তী রচনা ইত্যাদি বইতে মার্ক্সীয় সাংস্কৃতিক তত্ত্বপ্রস্থানকে যেন বাখতিন নতুন-নতুন আয়তনে নিয়ে গেছেন। কোনো প্রচলিত পথে তা হয়নি; নিজের পথ ও পাথেয় তিনি নিজেই পুনর্নির্মাণ করেছেন বারবার। সাধারণ বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি লোকসমাজের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে উপেক্ষা করেননি; বরং তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সঞ্জীবনী সুধা। উপন্যাসের প্রতিবেদনে তিনি যে শিল্পসংবিদের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ লক্ষ করেছেন, এর কারণ, লোকায়ত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বয়নের শরীর ও আত্মাকে নির্মাণ করে। এসময় বাখতিন যেসব পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদের মধ্যেও লোকজীবনের অনুষঙ্গ খুব স্পষ্ট; যেমন: ‘কার্নিভাল’। রাবেলে-বিষয়ক বইতে তিনি লিখেছেন, জনসাধারণ কার্নিভালকে দেখে না কেবল—তারা এর মধ্যে বাসও করে। বলা ভালো, প্রত্যেকে থাকে এতে। শব্দটির অভিধাগত অর্থ যদি বিচার করি, দেখব, জনগণের সমগ্র অংশ এর সঙ্গে যুক্ত। যখন কার্নিভাল চলতে থাকে, তার বাইরে জীবনের কোনো স্পন্দন থাকে না। যেহেতু এর পরিসরের কোনো সীমান্ত নেই, একে কেউ এড়াতে পারে না। কার্নিভাল যখন চলে, কেবলমাত্র তারই নিয়ম অনুযায়ী জীবন-যাপন করা সম্ভব; তবু এর মধ্যে সবাই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। সর্বজনীন চরিত্র এর সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য; সমগ্র জগতের পুনরুদয় ও পুনর্নবায়নকে কেবলমাত্র তারাই অনুভব করতে পারে যারা কার্নিভালে অংশ নেয়। বাখতিনের বক্তব্য নিবিড় ভাবে বিশ্লেষণ করলে আমাদের মনে হয়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনাই কার্নিভালের আকল্পকে গড়ে তুলেছে। ১৯১৭ সালের যুগান্তকারী ঘটনায় ব্যক্ত হয়েছে যৌথ বিশ্বাসের স্বপ্নময় সামগীতি; একে বলা যেতে পারে শোষিত-নিপীড়িত-প্রান্তিকায়িত

৮৩