পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

historical circumstances.’ (তদেব: ৯৩)। এভাবে নতুন প্রতিবেদনের যে যুক্তিবিন্যাস ফুটে উঠেছে, তাতে ব্যাকরণের বিধি কিংবা বাস্তবতার প্রত্যক্ষ অনুশাসন বড়ো নয়। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে দ্বিবাচনিকতার আধার ও আধেয় খুঁজেছেন বাখতিন, তাতে বাস্তবতা ও ব্যাকরণ পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। আসলে আধিপত্যবাদীদের প্রতাপাত্মক সন্দর্ভে কার্নিভালের তির্যক হাসি দিয়ে অন্তর্ঘাত করতে চেয়েছেন তিনি। নিম্নবর্গীয়দের নিরুচ্চার অবস্থান থেকে লক্ষ করেছেন সংঘর্ষ ও ঘাত-প্রতিঘাতে বিক্ষত রুশ সমাজকে। দ্বিবাচনিকতা যেন মুখোশের আড়াল থেকে মুখের আদল আবিষ্কার করার নিরন্তর প্রক্রিয়া, অপ্রতিহত এক প্রতিজ্ঞা। বাখতিনের প্রবাদপ্রতিম উচ্চারণ আমাদের মনে পড়ে আরো একবার: ‘প্রতিটি তাৎপর্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়’ এবং ‘প্রতিটি তাৎপর্য সামাজিক’। কার্নিভালের আকল্প যেন আরো একটু এগিয়ে আমাদের জানাতে চাইছে, যে-দিকে আলো পড়ে না সাধারণত—সেদিকেই খুঁজতে হয় আলোর আর্তি। তখন নতুন ঠিকানায় পৌঁছাতে পারি, অতিব্যক্ত স্বরের বদলে অনাবিষ্কৃত স্বরের শৌর্য ও সৌন্দর্য গড়ে নিতে পারি। ফলে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিচারে এই প্রক্রিয়া কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে না। প্রতিটি উচ্চারণকে তাৎপর্যবহ হতে হলে ভাবাদর্শগত প্রেক্ষিত, শ্রেণীবিভাজিত সমাজের অতীত ও বর্তমানকে স্বীকার করতে হয়। প্রান্তিকায়িত লোকসমাজ নিজস্ব তাগিদে যথাপ্রাপ্ত জগৎকে বিনির্মাণ করে; কেননা তা-ই সার্বিক পুনর্নির্মাণের আবশ্যিক ও ন্যূনতম প্রাক্‌শর্ত।

 বাখতিন জানিয়েছেন, প্রতিবেদনের সামাজিকতা সমস্ত নান্দনিক উদ্যোগকে অর্থবহ করে তোলে এবং নিজস্ব নিয়তির দিকে নিয়ে যায়। ‘Discourse in the Novel’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন ‘the life destiny of given discourse’ (১৯৮১: ২৯২) এর কথা যাকে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনুভব করতে হয়। পার্থক্য ও সমান্তরালতার উপলব্ধিতে স্পন্দিত বিভিন্ন বিষয়ের চেতনা একে অপরকে সৃষ্টি ও রূপান্তরিত করে চলেছে। বাখতিন যে সামাজিক প্রেক্ষিতকে উপস্থাপিত করেছেন, চেতনার বহুত্ব তার গোত্রলক্ষণ। আবার এর মধ্যে সন্নিবেশিত হচ্ছে বিবিধ অপরতার ধারাবাহিক অভিব্যক্তি। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ার শেষ নেই এবং তাতে বিচ্ছেদও নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোনের আভাস দিয়ে জটিল-এক সমগ্রতার আকরণ এরা গড়ে তোলে। সংশয়পীড়িত সময়-পর্বেও বাখতিন যে অনেকার্থদ্যোতনার তাত্ত্বিক আকল্প তুলে ধরতে পেরেছেন, এতে তাঁর একক বাচনের প্রতিরোধ-আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। আবার, দ্বিবাচনিকতার নিরন্তর প্রবাহ যেহেতু লক্ষ করছেন তিনি—সমাজতান্ত্রিক নবনির্মাণের প্রতিজ্ঞাও সৃজনশীল ভাবে পুনর্বিন্যস্ত হলো। সামাজিক কৃত্যের বহুত্ব দ্বন্দ্ববাদে অস্বীকৃত হয়, তা কিন্তু নয়। বাখতিন যেমন প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি পরিসরের কথা ভেবেছেন, তেমনি সামূহিক বাচনের আশ্রয় হিসেবে সমগ্র কাল ও সমগ্র পরিসরের কথাও ভেবেছেন। তবে তাঁর বিশেষত্ব হলো, সত্যের উদ্ভাসনে ‘dialogically interrelated set’ (তদেব: ২৯৩) এর গুরুত্বকে তিনি সর্বাত্মক করে তুলেছেন। এভাবে দ্বিবাচনিকতা ভাবাদর্শগত সংগ্রামেরও বিশিষ্টতম আয়ুধ হয়ে উঠেছে যা ব্যক্তিকে সামাজিক প্রেরণায় গ্রথিত করে বারবার। সুতরাং বাখতিন মার্ক্সীয় চেতনার নির্যাসকে সৃষ্টিশীল ভাবে প্রয়োগ করে সমকালের সংশয়কুহেলি ছিন্নভিন্ন করেছেন এবং চিরদিবসের সূর্যকে সমকাল থেকেও আরো বেশি সংশয়কণ্টকিত

৮৫