পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভবিষ্যতে ঈপ্সিত দিগন্তের দিশারি করে রেখেছেন—একথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

 বাখতিন কি তাহলে তাঁর তত্ত্ববিশ্বকে কল্পিত স্বর্গের আদলে গড়তে চেয়েছেন? তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী হিসেবে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের বহুবাচনিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, আমাদের কিন্তু তা মনে হয় না। বহুদিন মার্ক্সবাদীদের নতুন মানবসমাজের স্বপ্ন দেখার জন্যে কল্পিত স্বর্গের নির্মাতা বলে ঠাট্টা করা হয়েছে। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। বাখতিনের আকল্প অনুযায়ী প্রতাপের কথা না-বলে ভাষা-বাচন-প্রতিবেদনের কথা বললে তার কোনো তাৎপর্য থাকবে না। পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শোষণের আবহে কোনো আন্তরিক উচ্চারণ সম্ভব নয়। তাছাড়া ‘নিরপেক্ষ’ উচ্চারণ বলে কিছু হতে পারে না; কখনো বা প্রতাপের বশীভূত কখনো প্রতাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিব্যক্তি। এই হলো প্রতিবেদনের অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক চেতনার দ্বিবাচনিক প্রেক্ষিত। বাখতিনকে যাঁরা রাজনীতির সংক্রমণ থেকে মুক্ত করার জন্যে মার্ক্সবাদের সঙ্গে তাঁর সমস্ত সম্পর্ক মুছে ফেলতে চান—তাঁরা আসলে বাখতিনীয় অণুবিশ্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের চূড়ান্ত প্রযুক্তিনির্ভর আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়ে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিকায়িত জনসাধারণ যখন বিশ্বপুঁজিবাদের একবাচনিক সন্দর্ভে কেবল সন্ত্রাসের অনেকান্তিক বয়ন দেখতে পাচ্ছে—সেসময় বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা ও অনেকার্থদ্যোতনা, কার্নিভাল ও বহুস্বরিকতা যেন প্রতিবাদের আয়ুধ যোগান দিচ্ছে। যাকে ব্যারি রুটল্যাণ্ড ‘dialogic flux of collective desire’ বলেন, তারই প্রেরণায় তৃতীয় বিশ্বের দেশে-দেশে জেগে উঠছে জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা। অতিকেন্দ্রায়িত একবাচনিক সন্দর্ভের বিস্তার প্রতিরোধহীন তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে-রুদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি করছে, তার বিপ্রতীপে বাখতিনের প্রস্তাবিত কার্নিভাল ও দ্বিবাচনিকতা তুলে ধরছে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের পতাকা। সাম্প্রতিক ইতিহাস ও রাজনীতি বিশ্বায়নের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষিতে যখন ক্রমশ জটিলতর হয়ে উঠছে, একদিকে আধুনিকোত্তর ও অন্যদিকে উপনিবেশোত্তর জীবনের পার্থক্য ও সমান্তরালতা অনৈক্য এবং ঐক্যের অভূতপূর্ব ও অন্যোন্য-উদ্ভাসন সম্ভব করে তুলেছে—সেসময় দুটি প্রাগুক্ত আকল্প বিচিত্র বহুস্বরিকতার আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের উপর আন্তর্জাতিক পণ্যায়নের অভিঘাত যখন প্রবলতম, বাখতিনের ভাববীজগুলি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। কেননা সেইসব আকল্প ‘display...a built-in affinity for the oppressed and the marginal.’ (রবার্ট স্ট্যাম: ১৯৮৯: ২১)। কার্নিভালের মধ্য দিয়ে প্রকাশমান দ্বিবাচনিকতা তাই এই মুহূর্তে নিপীড়িতের রণকৌশল হিসেবে গৃহীত হতে পারে। মার্ক্সীয় চেতনার যা মৌল লক্ষ্য, বাখতিনের মধ্য দিয়ে আমরা আজ পৌঁছে যেতে পারছি সেই প্রতিবাদী প্রক্রিয়ায় যার সাহায্যে প্রান্তিকায়িত বর্গ বিকেন্দ্রায়নের আধেয় হয়ে উঠতে পারে। অবজ্ঞাত তৃতীয় বিশ্বে এইজন্যে এখন বাখতিন যেন পুনরাবিষ্কৃত চেতনার অক্ষয় তূণীর, মানবিক উদ্ভাসনের ভরসাস্থল, অন্তেবাসীদের পুনরুজ্জীবনের উৎস।

৮৬