পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) দ্বিতীয় ভাগ.djvu/১০৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

২২৯২ বাংলা বানানের নিয়ম সংস্কার করিতে কেহই চান না, প্রদেশভেদে উচ্চারণের কিঞ্চিৎ ভেদ হইলেও ক্ষতি হয় না। প্রচলিত শব্দের বানান সংস্কার যদি করিতে হয় তৰে, বানানের জটিলতা না বাড়াইয়া সরলতা সম্পাদনের চেষ্টাই কর্তব্য। নবাগত ৰা অল্পপরিচিত বিদেশী শব্দ-সম্বন্ধে বিশেষ বিচার আবশ্যক। এইপ্রকার শব্দের বাংলা বানান এখনও সব জনগৃহীত রূপে নিধারিত হয় নাই, অতএব সাধারণের যথেচ্ছতার উপর নির্ভর না করিয়া বানানের সরল নিয়ম গঠন করা কর্তব্য। অসংখ্য সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হইয়া আছে এবং প্রয়োজনমত এইরূপ আরও শব্দ গৃহীত হইতে পারে। এই সকল শব্দের বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধানাদির শাসনে সুনির্দিষ্ট হইয়াছে, সেজন্য তাহাতে হস্তক্ষেপ অবিধেয়। সমস্ত বাংলা শব্দের বানান এককালে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভবপর নয় ( নিয়ন্ত্রণ ক্রমে ক্রমে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই প্রবন্ধে বানানের কয়েকটি মাত্র নিয়ম দেওয়া হইয়াছে। নিয়মগুলি সাধারণভাবে প্রযােজ্য, কিন্তু শব্দবিশেষে ব্যতিক্রম হইবে। কেবল নিয়ম রচনা দ্বারা সমস্ত বাংলা শব্দের বানান নির্দেশ অসম্ভব। নিধারিত বানান অনুসারে একটি শব্দতালিকা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশের ব্যবস্থা হইতেছে। বলা বাহুল্য, পদ্যরচনায় সকল ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসারে বানান করা সম্ভবপর নয়। বানানের নিয়ম যাহাতে ৰত মান বাংলা ভাষায় প্রকৃতির অনুকুল হয় সেই চেষ্টা করা হইয়াছে। বিশিষ্ট লেখকগণ অধিকাংশ শব্দ যে রীতিতে বানান করেন তদনুসারে ইঈ উ উ জ ও-কার ঙ শযস প্রভৃতি প্রয়োগের সাধারণ নিয়ম গঠিত হইয়াছে। কতকগুলি শব্দের প্রচলিত বানানে ব্যতিক্রম দেখা যায়। সামঞ্জস্যের অন্য এইগুলিকেও যথাসম্ভব সাধারণ নিয়মের অনুযায়ী করা হইয়াছে। পূর্বে কেবল 'খুদী, সয়তান, সহর, পলিস, ক্লাশ' প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু আজকাল অনেকে মল শব্দ-সম্বন্ধে অবহিত হইয়া ‘খুশী, শয়তান, শহর, পালিশ, ক্লাস লিখিতেছেন। এই নীতিতে সহজেই ‘নকশা, শরবৎ, শরম, শেমিজ, জিনিস, সাণি' প্রভৃতি নিয়মানুযায়ী বানান প্রচলিত হইতে পারিবে। অবশ্য, কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম না করিলে চলিবে না, কিন্তু ব্যতিক্রম যত কম হয় ততই ভাল। বিকল্প বাঞ্ছনীয় নয়, তথাপি যেখানে দুই প্রকার বানানের পক্ষেই প্রবল অভিমত পাওয়া গিয়াছে সেখানে বিকল্পের বিধান করিতে হইয়াছে। পূর্বে সান্তি, সঙ্খা' প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু এখন কৈল সংক্রান্তি, সংখ্যা' চলিতেছে। এই রীতিতে ‘ভয়ঙ্কর, সঙ্গম' প্রভৃতি স্থানে ‘ভয়ংকর, সংগম' লিখিলে বানান সহজ হইবে। কালক্রমে সরলতর বানানই চলিবে এই আশায় এই প্রকার শব্দে বিকল্পের বিধান দেওয়া হইয়াছে। এই প্রকার শব্দের সংখ্যা অধিক নয় সে জন্য যদি কিছু কাল দুই প্রকার বানানই চলে (যেমন এখন ‘অহঙ্কার, অহংকাব’ চলিতেছে। তবে ক্ষতি হইবে না। নিয়মাবলী পূর্বসংস্করণে সংস্কৃত বা অদ্ভব শব্দে অন্ত বিসর্গ ও ইস চিহ্ন প্রয়ােগের নিয়ম দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু বর্তমান সংস্করণে তাহা বর্জিত হইয়াছে। বাংলায় শব্দে অন্ত্য বিসর্গ ও হসচিহ্ন লােপ পাইয়াছে, যথা-‘ঘশ, বিপদ' ; আরও কতকগুলি শব্দে লােপের উপক্রম দেখা যাইতেছে, যথা-'শ্রেয়, সদ্যমান, সম্রাট’। এজন্য অনেকে মনে করেন যে এ সম্বন্ধে ধরাবাধা নিয়ম রচনার সময় এখনও জাসে নাই। রেফের পর দ্বিত্ববর্জন এবং অ সংস্কৃত শব্দে ণ বর্জন এই দুই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আপত্তি হইয়াছে। এই দুই বিষয়ের আলােচনা কিঞ্চিৎ সবিস্তারে করা হইল। বাংলার কয়েকটি বর্ণে রেফের পর খিত্ব প্রচলিত আছে, সকল বর্ণে নাই, যথা-কৰ্ম্ম, সর্ব’, কিন্তু ‘ক, সর্গ'। হিশী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় বিত্ব হয় না। এই অনাবশ্যক বিত্ব বর্জন করিলে বাংলায় প্রচলিত অসংখ্য শব্দের বানান অপেক্ষাকৃত সরল হইবে। যে দুই শত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন তাহাদের দুই জন ব্যতীত সকলেই বিবর্জনের পক্ষে। কয়েকজন প্রবীণ লেখক বহুকাল হইতে তাহাদের লেখায় দ্বিত্ব পরিহার করিয়াছেন। আজকাল বঙ্গদেশে প্রকাশিত অনেক সংস্কৃত পুস্তকে জিত্ব অর্জিত হইয়াছে। কেহ কেহ বলেন, বাংলা উচ্চারণে নেফাক্রান্ত বর্ণে অতিরিক্ত জোর পড়ে, সেজন্য বিত্ব আবশ্যক : ‘সর্ব’= স +ৰ' নয়, 'স+ '। এই যুক্তি নিতান্ত অসার, কারণ অন্যান্য যুাক্ষরে যে জোর পড়ে, রেফাক্রান্ত বর্ণে তাহার অধিক পড়ে না। 'ভক্তি’ ও ‘ভত্তি'র উচ্চারণে জোরের তারতম্য নাই; অনুরুপ-স্বল্প, সর্ব ; কষ, কর্মঠ ; উদ্বোধ, দুর্বোধ ; পলতা, পর্দা'। সর্গ, সর্প, সর্ব শব্দে দ্বিত্ব থাকায় না-থাকায় জোয়েয় ইতরবিশেষ হয় না; অনুরূপ—'অর্থ, অর্থ : কপূর, কম; গর্ভ, গর্ব । নিঝর, নির্জয়'। অতএব সর্ব’ পর্দা, অধ, পর্ব' প্রভৃতি লিখিলে কিছুমাত্র ক্ষতি হইবে না। আর এক আপত্তি—অনেকে কাৰ্য' শব্দের উচ্চারণ 'কাইজ তুল্য করিয়া থাকেন; কাষ' লিখিলে কার্জ' উচ্চারণের আশঙ্কা আছে। কাইর্জ' বা 'কার্জ' কোন উচ্চারণ ভাল তাহার বিচার অনাবশ্যক। যাহারা ফাইজ' উচ্চারণ করিয়া থাকেন, য ফলা বাদ দিয়া কাৰ্য' লিখিলেও তাহারা অতীষ্ট উচ্চারণ করিতে পারিবেন। কাল' (সময়) এবং 'কাল' (কল্য) এই দুই শব্দের উচ্চারণ কলিকাতা অঞ্চলে সমান, কিন্তু বাংলা দেশের বহুলে ‘কাল’ (কল্য) শব্দের উচ্চারণ ‘ফাইল’ তুল্য। যাহারা শেষােক্ত উচ্চারণ করেন তাহাদের য-ফলা বা অন্য চিহ্নের প্রয়ােজন হয় না, শব্দটি চিনিয়াই তাহারা অনায়াসে অভ্যস্ত উচ্চাণ করেন। অতএব, কার্ব' লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, এই আশঙ্কা অমুলক। কেহ কেহ বলেন, যখন রেফের পর বিত্ব করা বা মা করা উভয়ই ব্যাকরণসম্মত তখন বিয়ের ব্যবস্থা রাখাই ভাল। অনেক সংস্কৃত শব্দের দুই প্রকার বানান অভিধানে আছে, যথা-খরণী, রণি ; শহী, মহি; উর্ণা, উর্ণা'। কিন্তু বাংলা