পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম ভাগ.djvu/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা

 ব্যাকরণ ও অভিধান ভাষার অভ্রান্ত ইতিহাস। শব্দের পূর্ব্বাপর রূপ এবং ভাষায় তাহার ব্যবহার অভিধানের অঙ্গীভূত হওয়ার প্রয়োজন আছে। বাঙ্গালাভাষার অভিধানে সে চেষ্টার ব্যতিক্রম করা হয় নাই। ইহাতে এক শব্দের একাধিক বানানজনিত রূপান্তর একই পর্য্যায়ে প্রদর্শিত হইয়াছে; হস্তলিখিত বা মুদ্রিত প্রাচীন মূল-গ্রন্থের পাঠানুরূপ বানান, প্রাচীন ও মধ্যযুগ হইতে বর্ত্তমান সময় পর্য্যন্ত Phonetic spelling অর্থাৎ শব্দোচ্চারণগত বানান যাহা স্থান কাল ভেদে পরিবর্ত্তনের মধ্য দিয়া অধুনা সাহিত্যে স্থান পাইয়া সুরক্ষিত হইয়াছে তাহাও, এই অভিধানের শব্দসম্পদ বৃদ্ধি করিয়াছে। প্রায়ই সংস্কৃত শব্দের প্রাকৃত উচ্চারণানুযায়ী যুক্তাক্ষর ভাঙ্গিয়া, বর্ণ লোপ করিয়া, বর্ণ-বিপর্য্যয় ঘটাইয়া এবং পরিবর্ত্তদ্বারা কোমল ও সহজকথ্য করা হয়। পদ্যে কোমলার্থে, ছন্দানুরোধে, ব্যবহার-বাহুল্যে কোল-সাহিত্যে তৎসমুদয় প্রবেশলাভ করিয়া ভাষার অন্তরঙ্গ হইয়া পড়ে। বৈদেশিক শব্দ সম্বন্ধেও এই নীতি। শ্রী > সিরি, ছিরি; প্রীতি > পীরতি, পিরিতি, পির্তি; প্রসব > পরসব, পরসো; ইং gre, gree (গৃ, গ্রী) > গিরি; green > গিরিণ; agreement > গিরিমেণ্ট্ (ইং অনভিজ্ঞদের মুখে “গিরিমেণ্টো”), স্পর্শ > পর্শো, পরশো ইত্যাদি। লোক সাহিত্যে এরূপ শব্দোচ্চারণ-বিকারেরও স্থান আছে।

 সংস্কৃত অভিধানে শব্দের পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ বা ত্রিলিঙ্গ রূপ নির্ণয় একটি প্রধান বিষয়। সংস্কৃত শব্দের লিঙ্গ শব্দার্থগত নহে; তাহা পুং-স্ত্রী-নপুংসক-বাচক বা ত্রিলিঙ্গবাচক প্রত্যয়াদি-সিদ্ধ শব্দগত। তদনুসরণে হিন্দী, উর্দ্দু প্রভৃতি ভাষায় পুংলিঙ্গান্ত শব্দার্থ পুংবাচক না হইলেও পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গান্ত শব্দ স্ত্রীবাচক না হইলেও, স্ত্রীলিঙ্গ এবং ক্লীব বা অপ্রাণীবাচক শব্দ পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গও হইতে পারে। হিন্দীতে পানী (জল) অপ্রাণীবাচক হইয়াও পুংলিঙ্গ (‘পানী আতা হায়্’, কিন্তু রাণী শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ (‘রাণী আতী হায়’)। রাখ ও রাখী (ভস্ম) উর্দ্দু ও হিন্দীতে অপ্রাণীবাচক হইয়াও স্ত্রীলিঙ্গ। আরবী “কব্জ়্”, “কব্জা” (অধিকার possession) একার্থক অপ্রাণীবাচক হইয়াও, স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ। ইতর মুনির অপত্য, মতান্তরে ঋষিপত্নী ইতরার গর্ভজাত পুত্রার্থে “ঐতরেয়” পুরুষ হইয়াও সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অভিধানে ক্লীবলিঙ্গ। এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই। সংস্কৃতের এই আদর্শ বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানে পূর্ব্বাপর অনুসৃত হইয়া আসিতেছে বটে, কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় লিঙ্গানুশাসনের এই কঠোরতা বা অপরিহার্য্যতা নাই। অপ্রাণীবাচক বার্ত্তাকু (বেগুন), বারী (জলপাত্র, রজ্জু), শাখা, নিশা, রাত্রি, সম্পত্তি, নীতি প্রভৃতি স্ত্রীলিঙ্গ বলিয়া বিশেষিত। এইরূপ বিদ্যুৎ, মৎস্যণ্ডিকা ও মৎস্যণ্ডী (মিছরী, মঠ ইত্যাদি অর্থে) অভিধানে স্ত্রীলিঙ্গ বলিয়া উক্ত। কিন্তু বাঙ্গালা আলঙ্কারিক ভাষায় উৎকৰ্ষাপকর্ষ-জ্ঞাপক বর্ণনাস্থলে তাহাদের স্ত্রীলিঙ্গবাচক-বিশেষণ ব্যবহার রুচিসঙ্গতও মনে হয় না। বাঙ্গালা অভিধান নামধেয় শব্দকোষে এমনও সংস্কৃত শব্দ ও তার স্ত্রীলিঙ্গরূপ দৃষ্টিগোচর হয়, কথ্য ও লেখ্য বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যে যাহার ব্যবহার নাই। সেই সকল স্ত্রীলিঙ্গরূপ