পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম ভাগ.djvu/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।



ভূমিকা

সংস্কৃত কোষের বঙ্গানুবাদ অথবা প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত-বাঙ্গালা-অভিধানে পরিণত হইল। তখন হইতে বাঙ্গালা ও সংস্কৃত শিক্ষার্থীদিগের বিশেষরূপ “ব্যবহারোপযোগী” করিবার চেষ্টাই পূর্ব্ব পূর্ব্ব সঙ্কলনকর্ত্তাদের প্রধান লক্ষ হইয়াছিল। হলহেড্‌ সাহেবের ব্যাকরণের ন্যায় বাঙ্গালা ও ইংরেজীতে শ্রীরামপুরের পাদরী কেরী সাহেব সঙ্কলিত ১২০৲ টাকা মূল্যের ৮০,০০০ শব্দ-সম্বলিত বিরাটকায় অভিধান ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহার ৮ বৎসর পরে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে স্বনামখ্যাত হাউটন (Haughton) সাহেব বাঙ্গালা-ইংরেজী বৃহৎ অভিধান এবং তৎপর বৎসর রামকমল সেন মহাশয় ইংরেজী বাঙ্গালা অভিধান সঙ্কলন করিয়াছিলেন। পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় তাঁহার “বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব” গ্রন্থের ২য় সংস্করণে, ১২৯৪ সালে লিখিয়াছেন (পৃ. ১৫৪), “ফর্‌ষ্টর্ সাহেব *** বাঙ্গালা ভাষার সর্ব্বপ্রথম অভিধান প্রস্তুত করেন। সে অভিধান এখন আর প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না।” যাহা হউক সাহিত্য, ব্যাকরণ ও অভিধানের মধ্য দিয়া সাধুভাষা নামে বাঙ্গালার লিখিত ভাষা কথ্য-ভাষা হইতে যে ভাবে পৃথক্ হইয়া পড়িতেছিল, তাহা ভয়াবহ হইয়াই উঠিত; কিন্তু, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় পদ্যপ্লাবিত বাঙ্গালার স্রোত ফিরাইয়া গদ্যের প্রবর্ত্তন করিয়া উক্ত পার্থক্য দূর করিবার পথ প্রশস্ত করিয়া দেন। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় রসভাবাত্মক উচ্চ সাহিত্য-সুলভ গুণ-লক্ষণ-যুক্ত রীতি-সিদ্ধ বাঙ্গালার সৃষ্টি করিয়া “পণ্ডিতী বাঙ্গালার” উৎকটতার কলঙ্ক মোচন করেন। অতঃপর, যিনি আধুনিক যুগোপযোগী শক্তিশালী গদ্যরচনার পথ প্রদর্শন করেন, তিনি “বঙ্গদর্শন"-প্রবর্ত্তক, কথা-সাহিত্য-জগতের অবিসম্বাদী সম্রাট স্বৰ্গত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁহার সময় হইতে কত সাহিত্যরথী বর্ত্তমান কবি-সম্রাট মহামনস্বী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্য্যন্ত এবং টেকচাঁদ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ হইতে বঙ্গের “বীরবল”[১] পর্য্যন্ত উচ্চ সাহিত্যিক ভাষার সহিত “আলালী” ভাষার অপূর্ব্ব মিশ্রণে বাঙ্গালীর প্রাণের ভাষা গড়িয়া তুলিয়াছেন। ভাষাসংস্কারকগণের বিশ্ব-নাগরিকতা-সুলভ প্রচেষ্টার ফলে বাঙ্গালা কথ্য-ভাষা হইতে লেখ্য-ভাষায় সেই ভয়াবহ এবং ক্রমবর্দ্ধমান অনপনেয় পার্থক্য জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে লোপ পাইয়া যে একরূপতা প্রাপ্ত হইতে চলিয়াছে, সাধারণের রুচি, আধুনিক সংবাদ পত্রাদির ভাষা ও বর্ত্তমান লোক-সাহিত্যের মধ্য দিয়া তাহার আভাষও পাওয়া যাইতেছে। অবশ্য ইহা স্বীকার্য্য যে, উচ্চ-বিশুদ্ধ-সাহিত্য-কলার আদর্শ চিরদিনই গৌরবের উচ্চ-শিখরে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যরক্ষা করিয়া চলিবে। যাহা হউক, এক্ষণে, ভাষার উপযোগী সংস্কৃত-বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানের পরিবর্ত্তে খাঁটি বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানের অভাব-মোচনের সহিত বাঙ্গালীর মাতৃভাষাকে অনন্ত শক্তিসঞ্চারিণী করিয়া তুলিবার যুগ দেখা দিয়াছে। অনার্য্য অধিবাসীদের দেশে আর্য্যজাতির অভ্যুদয়ের আদিম যুগ হইতে পূর্ব্বাপর রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম্ম ও যাবতীয় বিপ্লব,

  1. “সবুজপত্র” সম্পাদক শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী, বার-এট্-ল।