পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১০৪
বিচিত্র প্রবন্ধ

মধ্যেই নজরবন্দি করিয়া রাখিয়াছিল। আজ হঠাৎ তুচ্ছতা একেবীর চলিয়া গেছে। আজ দেখিতেছি, চির-অপরিচিতকে এতদিন পরিচিত বলিয়া দেখিতেছিলাম, ভালো করিয়া দেখিতে ছিলামই না। আজ এই যাহা-কিছু, সমস্তকেই দেখিয়া শেষ করিতে পারিতেছি না। আজ সেই সমস্তই আমার চারিদিকে আছে, অথচ তাহারা আমাকে আটক করিয়া রাখে নাই—তাহারা প্রত্যেকেই আমাকে পথ ছাড়িয়া দিয়াছে। আমার পাগল এইখানেই ছিলেন,—সেই অপূর্ব, অপরিচিত, অপরূপ, এই মুদির দোকানের খোড়োচালের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করেন নাই—কেবল, যে-আলোকে তাঁহাকে দেখা যায়, সে-আলোক আমার চোখের উপরে ছিল না। আজ আশ্চর্য এই যে, ঐ সম্মুখের দৃশ্য, ঐ কাছের জিনিষ আমার কাছে একটি বহুসুদূরের মহিমা লাভ করিয়াছে। উহার সঙ্গে গৌরীশঙ্করের তুষারবেষ্টিত দুর্গমতা, মহাসমুদ্রের তরঙ্গচঞ্চল দুস্তরতা, আপনাদের সজাতিত্ব জ্ঞাপন করিতেছে।

 এম্‌নি করিয়া হঠাৎ একদিন জানিতে পারা যায়, যাহার সঙ্গে অত্যন্ত ঘরকন্না পাতাইয়া বসিয়াছিলাম, সে আমার ঘরকন্নার বাহিরে। আমি যাহাকে প্রতিমুহূর্তের বাধা-বরাদ্দ বলিয়া নিতান্ত নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলাম, তাহার মতো দুর্লভ দুরায়ত্ত জিনিষ কিছুই নই। আমি যাহাকে ভালোরূপ জানি মনে করিয়া তাহার চারিদিকে সীমানা আঁকিয়া-দিয়া খাতিজমা হইয়া বসিয়া ছিলাম, সে দেখি, কখন্ একমুহূর্তের মধ্যে সমস্ত সীমানা পার হইয়া অপূর্বরহস্যময় হইয়া উঠিয়াছে। যাহাকে নিয়মের দিক্ দিয়া, স্থিতির দিক্ দিয়া বেশ ছোটোখাটো, বেশ দস্তুর সঙ্গত, বেশ আপনার বলিয়াই বোধ হইয়াছিল, তাহাকে ভাঙনের দিক হইতে, ঐ শ্মশানচারী পাগলের তরফ হইতে হঠাৎ দেখিতে পাইলে মুখে আর বাক্য সরে না—আশ্চর্য্য! ও কে! যাহাকে চিরদিন জানিয়াছি, সেই একে! যে একদিকে ঘরের, সে আর একদিকে অন্তরের