পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
আষাঢ়
১০৭

ঝুলিতেছে, আর বন্দিনী পূর্ব্বদিগ্বধূ পাশে দাঁড়াইয়া অশ্রুনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়িত কঙ্কণখানি ঝলকিয়া তুলিতেছে।

 আর শীতটা বৈশ্য। তাহার পাকা ধান কাটাই-মাড়াইয়ের আয়োজনে চারিটি প্রহর ব্যস্ত, কলাই যব ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরণীর ডালা পরিপূর্ণ। প্রাঙ্গণে গোলা ভরিয়া উঠিয়াছে, গোষ্ঠে গরুর পাল রোমন্থ করিতেছে, ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল, পথে পথে ভারে মন্থর হইয়া গাড়ি চলিয়াছে; আর ঘরে ঘরে নবান্ন এবং পিঠাপার্ব্বণের উদ্যোগে ঢেঁকিশালা মুখরিত।

 এই তিনটেই প্রধান বর্ণ। আর শূদ্র যদি বলল সে শরৎ ও বসন্ত। একজন শীতের, আর একজন গ্রীষ্মের তল্পি বহিয়া আনে। মানুষের সঙ্গে এইখানে প্রকৃতির তফাৎ। প্রকৃতির ব্যবস্থায় যেখানে সেবা সেইখানেই সৌন্দর্য্য, যেখানে নম্রতা সেইখানেই গৌরব। তাহার সভার শূদ্র যে, সে ক্ষুদ্র নহে, ভার যে বহন করে সমস্ত অভিরণ তাহারই। তাই তো শরতের নীল পাগ্‌ড়ির উপরে, সোনার কল্‌কা, বসন্তের সুগন্ধ শীত উত্তরীয়খানি ফুলকাটা। ইহারা যে পাদুকা পরিয়া ধরণী-পথে বিচরণ করে তাহা রং-বেরঙের সূত্রশিল্পে বুটিদার; ইহাদের অঙ্গদে কুণ্ডলে অঙ্গুরীয়ে জহরতের সীমা নাই।

 এই তো পাঁচটার হিসাব পাওয়া গেল। লোকে কিন্তু ছয়টা ঋতুর কথাই বলিয়া থাকে। ওটা নেহাৎ জোড় মিলাইবার জন্য। তাহারা জানে বেজোড় লইয়াই প্রকৃতির যত বাহার। ৩৬৫ দিনকে দুই দিয়া ভাগ করো—৩৬ পর্য্যন্ত বেশ মেলে কিন্তু সব-শেষের ঐ ছোট্টো পাঁচ-টি কিছুতেই বাগ মানিতে চায় না। দুইয়ে দুইয়ে মিল হইয়া গেলে সে মিল থামিয়া যায়, অলস হইয়া পড়ে। এই জন্য কোথা হইতে একটা তিন আসিয়া সেটাকে নাড়া দিয়া তাহার যত রকম সঙ্গীত সমস্তটা বাজাইয়া তোলে।