পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
চিঠির টুক্‌রি
১৬৭

আনন্দময় আত্মানুভূতি আছে, কোনো উপায়ে যদি বাহিরের অবিশ্রাম নানা গোলমাল থেকে ছুটি পাওয়া যায়, তাহোলে আপন সত্তার নির্ম্মল উপলব্ধিকে পরম সত্তার সেই ধ্রুব আনন্দে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাই। আমরা যখন নানাখানাকে কেবলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়াই, তখনি সমগ্র বোধটা হারিয়ে যায়, সেই অখণ্ডই হচ্চেন উপনিষৎ যাকে বলেন ভূমা। এই ভূমার মধ্যে অভিনিবিষ্ট হবার যে আনন্দ তার তুলনা হয় না। অমনি চারিদিকের ছোটো ছোটো জিনিষকে আমরা অসীমের ভূমিকার মধ্যে দেখতে পাই। ঐ যে বল্লেম আমার শুশ্রূষালয়ে অল্পখানিকটা সূর্য্যের আলো দেখতে পেতেন, কিন্তু সেইটুকুতেই আমাকে অখণ্ড জ্যোতিঃস্বরূপ বেশ স্পর্শ দিত—যে জ্যোতিঃ আনন্দময়। মাঝে মাঝে কোনো ইংরেজবন্ধু আমাকে দেখতে আসতেন। সাধারণতঃ বহুলোকের মাঝখানে তাঁদের ঠিক মূল্যটি পাইনি। কিন্তু এই ঘরটির মধ্যে যখন তারা আসতেন তখন একেবারে পূর্ণভাবে তাঁদের পাওয়া যেত, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ স্বভাবতই অসামান্য। সে একান্তই বিশেষ। কিন্তু তাদের আমরা অনেকের সঙ্গে তাল পাকিয়ে দেখি এই জন্যেই ঠিকমতো দেখি না। কিন্তু জনহীনতার বৃহৎ অবকাশের মধ্যে যখন কাউকে দেখি, তখন তাকে বিশেষভাবে সত্য ক’রে দেখার আনন্দ পাই। তাকে ধাঁ ক’রে এড়িয়ে যাবার জো থাকে না। তখন সে আপন ঐকান্তিকতার মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠে। বড়ো হয়ে ওঠে বললে ভুল হয়। সে যথার্থ হয়। অন্য সময় আমাদের দৃষ্টির জড়তায় সে ছোটো হয়ে থাকে। কথাটা একটু অদ্ভুত শোনায়, কিন্তু আরোগ্যশালার নিঃশঙ্কতা ও নিঃস্তব্ধতার মধ্যে আমি যে নিরবচ্ছিন্ন গভীর আনন্দ পেয়েছি জীবনে তেমন আনন্দ বেশিবার পাইনি। প্রথমবার যখন আমেরিকায়যাত্রা উপলক্ষ্যে অতলান্তিক পাড়ি দিয়েছিলাম, জাহাজটা ছিল জীর্ণ, সমুদ্র ছিল অশান্ত, অসুস্থ শরীর নিয়ে ক্যাবিনের মধ্যে অবরুদ্ধ ছিলাম।