পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বিচিত্র প্রবন্ধ

হইল যে, কাপ্তেন যখন নাই তখন নোঙরের অচল-শরণ অবলম্বন করাই শ্রেয়। দাদা বলিলেন তাহার আবশ্যক নাই, কাপ্তেনের নীচেকার লোকেরা কাপ্তেনের চেয়ে কোনো অংশে নূন্য নহে। কর্ত্তাবাবুরও সেইরূপ মত। বাকি সকলে চুপ করিয়া রহিল কিন্তু তাহাদের মনের ভিতরটা আর কিছুতেই প্রসন্ন হইল না। তবে, দেখিলাম নাকি জাহাজটা সত্য সত্যই চলিতেছে, আর, হাঁক-ডাকেও কাপ্তেনের অভাব সম্পূর্ণ ঢাকা পড়িয়াছে, তাই চুপ মারিয়া রহিলাম। হঠাৎ জাহাজের হৃদয়ের ধুক-ধুক শব্দ বন্ধ হইয়া গেল—কল চলিতেছে না—নোঙর ফেলো, নোঙর ফেলো বলিয়া শব্দ উঠিল—নোঙর ফেলা হইল। কলের এক জায়গায় কোথায় একটা জোড় খুলিয়া গেছে—সেটা মেরামত করিলে তবে জাহাজ চলিবে। মেরামত আরম্ভ হইল! এখন বেলা সাড়ে-দশটা, দেড়টার পূর্ব্বে মেরামত সমাপ্ত হইবার সম্ভাবনা নাই।

 বসিয়া বসিয়া গঙ্গাতীরের শোভা দেখিতে লাগিলাম। শান্তিপুরের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গাতীরের যেমন শোভা এমন আর কোথায় আছে! গাছপালা ছায়া কুটীর-নয়নের আনন্দ অবিরল সারি সারি দুইধারে বরাবর চলিয়াছে—কোথাও বিরাম নাই। কোথাও বা তটভূমি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন হইয়া গঙ্গার কোলে আসিয়া গড়াইয়া পড়িয়াছে, কোথাও বা একেবারে নদীর জল পর্য্যন্ত ঘন গাছপালা লতাজালে জড়িত হইয়া ঝুঁকিয়া আসিয়াছে—জলের উপর তাহাদের ছায়া অবিশ্রাম দুলিতেছে; কতকগুলি সূর্য্যকিরণ সেই ছায়ার মাঝে মাঝে ঝিকমিক করিতেছে, আর বাকি কতকগুলি, গাছপালার কম্পমান কচি মসৃণ সবুজ পাতার উপরে চিকচিক্ করিয়া উঠিতেছে। একটা-বা নৌকা তাহার কাছাকাছি গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা রহিয়াছে, সে সেই ছায়ার, নিচে, অবিশ্রাম জলের কুলকুল শব্দে, মৃদু মৃদু দোল খাইয়া বড় আরামের ঘুমাইতেছে। তাহার আর এক পাশে বড় বড় গাছের অতি