পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১২
বিচিত্র প্রবন্ধ

 এখন মধ্যাহ্ন। আমার সমুখে একটা ডেক্স, পা-পোষে একটা কালো মোটা কুকুর ঘুমাইতেছে —বারান্দায় শিকলি-বাঁধা একটা বাঁদর লেজের উকুন বাছিতেছে, তিনটে কাক আলিসার উপরে বসিয়া অকারণ চেঁচাইতেছে এবং এক এক-দার খপ করিয়া বাঁদরের ভুক্তাবশিষ্ট ভাত একচঞ্চু লইয়া ছাতের উপরে উড়িয়া বসিতেছে। ঘরের কোণে একটা প্রাচীন হার্ম্মোনিয়ম বাদ্যের মধ্যে গোটাকতক ইঁদুর খট্‌ খট্‌ করিতেছে। কলিকাতা সহরের ইমারতের একটি শুষ্ক কঠিন কামরা, ইহারি মধ্যে আমি গঙ্গার আবাহন করিতেছি—তপঃক্ষীণ জহ্নমুনির শুষ্ক পাকস্থলীর অপেক্ষা এখানে ঢের বেশি স্থান আছে। আর, স্থান-সঙ্কীর্ণতা বলিয়া কোনো পদার্থ প্রকৃতির মধ্যে নাই। সে আমাদের মনে। দেখে-বীজের মধ্যে অরণ্য, একটি জীবের মধ্যে তাহার অনন্ত বংশপরম্পরা। আমি যে ঐ ষ্টীফেন সাহেবের এক বোতল ব্লুব্লাক কালী কিনিয়া আনিয়াছি, উহারি প্রত্যেক ফোঁটার মধ্যে কত পাঠকের সুযুপ্তি মাদার-টিংচার আকারে বিরাজ করিতেছে। এই কালীর বোতল দৈবক্রমে যদি সুযোগ্য, হাতে পড়িত তবে ওটাকে দেখিলে ভাবিতাম, সৃষ্টির পূর্ব্ববর্ত্তী অন্ধকারের মধ্যে এই বিচিত্র আলোকময় অনর জগৎ যেমন প্রচ্ছন্ন ছিল, তেম্‌নি ঐ এক বোতল অন্ধকারের মধ্যে কত আলোকময় নুতন সৃষ্টি প্রচ্ছন্ন আছে। একটা বোতল দেখিয়াই এত কথা মনে উঠে, যেখানে ষ্টীফেন সাহেবের কালীর কারখানা সেখানে দাঁড়াইয়া একবার ভাবিলে বোধ করি মাথা ঠিক রাখিতে পারি না। কত পুঁথি, কত চটি, কত যশ, কত কলঙ্ক, কত জ্ঞান, কত পাগলামী, কত ফঁসির হুকুম, যুদ্ধের ঘোষণা, প্রেমের লিপি কালো কালো হইয়া স্রোত বাহিয়া বাহির হইতেছে! ঐ স্রোত যখন সমস্ত জগতের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে—তখন—দূর হউক্‌ কালী যে ক্রমেই গড়াইতে চলিল, স্টাফেন সাহেবের সমস্ত কারখানাটাই দৈবাৎ যেন উল্টাইয়া পড়িয়াছে;—এবারে ব্লটিং কাগজের কথা মনে