পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৪
বিচিত্র প্রবন্ধ

হাত জলের নিচে নামিয়া পড়িল। একমাত্র আনন্দের বিষয় এই ছিল যে, আমাদিগকেও অতদূর নামিতে হয় নাই। কিন্তু সহসা তাহারই সম্ভাবনা সম্বন্ধে চৈতন্য জন্মিল। এ সম্বন্ধে আমরা যতই তলাইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ততই আমাদের তলাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা মনে মনে উদয় হইতে লাগিল। এই সময় দিনমণি অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন। বরিশালে যাইবার পথ অপেক্ষা বরিশালে না যাইবার পথ অত্যন্ত সহজ ও সংক্ষিপ্ত এ বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে দাদা জাহাজের ছাদের উপর পায়চারি করিতে লাগিলেন। একটা মোটা কাছির কুণ্ডলীর উপর বসিয়া এই ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে হাস্য-কৌতুকের আলো জ্বালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম—কিন্তু বর্ষাকালের দেশলাই কাঠির মতো সেগুলা ভালো করিয়া জলিল না। অনেক ঘর্ষণে থাকিয়া থাকিয়া অমনি একটু একটু চমক মারিতে লাগিল। যখন সরোজিনী জাহাজ তাঁহার যাত্রীসমেত গঙ্গা-গর্ভের পঙ্কিল বিশ্রাম শয্যায় চতুর্বর্গ লাভ করিয়াছেন, তখন খবরের কাগজের Sad accident এর কোটায় একটি মাত্র প্যারাগ্রাফে চারিটি মাত্র লাইনের মধ্যে কেমন সংক্ষেপে নির্ব্বাণ মুক্তি লাভ করিব সে বিষয়ে নানা কথা অনুমান করিতে লাগিলাম। এই সংবাদটি এক চামচ গরম চায়ের সহিত অতি ক্ষুদ্র একটি বটিকার মতো কেমন অবাধে পাঠকদের গলা দিয়া নামিয়া যাইবে, তাহা কল্পনা করা গেল। বন্ধুরা বর্ত্তমান লেখকের সম্বন্ধে বলিবেন—“আহা কত বড়ো মহাশয় লোকটাই গেছেন গো,—এমন আর হইবে না!” এবং লেখকের পূজনীয়া ভ্রাতৃজায়া সম্বন্ধে বলিবেন—“আহা, দোষে গুণে জড়িত মানুষটা ছিল-যমন তেমন হোক্ তবু তো ঘরটা জুড়ে ছিল!” ইত্যাদি ইত্যাদি। জাতার মধ্য হইতে যেমন বিমল শুভ্র ময়দা পিষিয়া বাহির হইতে থাকে, তেমনি বৌঠাকুরাণীর চাপা ঠোঁট জোড়ার মধ্য হইতে হাসিরাশি ভাঙিয়া বাহির হইতে লাগিল।