পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৪৮
বিচিত্র প্রবন্ধ

 —আমার যেন বক্ষঃস্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল! আমি রুদ্ধস্বরে, বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিলাম—তার পরে কী হইল!

 দিদিমা বলিতে লাগিলেন-তার পরে—কিন্তু সে কথায় আর কাজ কী? সে যে আরো অসম্ভব! গল্পের প্রধান নায়ক সর্পাঘাতে মারা গেল, তবুও তার পরে? বালক তখন জানিত না, মৃত্যুর পরেও একটা তার পরে থাকিতে পারে বটে, কিন্তু সে তারপরের উত্তর কোনো দিদিমার দিদিমাও দিতে পারে না। বিশ্বাসের বলে সাবিত্রী মৃত্যুরও অনুগমন করিয়াছিলেন। শিশুরও প্রবল বিশ্বাস, এই জন্য সে মৃত্যুর অঞ্চল ধরিয়া ফিরাইতে চায়, কিছুতেই মনে করিতে পারে না যে, তাহার মাষ্টারবিহীন একসন্ধ্যাবেলাকার এত সাধের গল্পটি হঠাৎ একটি সর্পাঘাতেই মারা গেল! কাজেই দিদিমাকে সেই মহাপরিণামের চিরনিরুদ্ধ গৃহ হইতে গল্পটিকে আবার ফিরাইয়া আনিতে হয়। কিন্তু এত সহজে সেটি সাধন করেন, এমন অনায়াসে;—কেবল হয়তো একটা কলার ভেলায় ভাসাইয়া দিয়া গুটি দুই মন্ত্র পডিয়া মাত্র—যাহাতে সেই ঝুপ্‌ঝুপ্‌ বৃষ্টির রাত্রে স্তিমিত প্রদীপে বালকের মনে মৃত্যুর মূর্ত্তি অত্যন্ত অকঠোর হইয়া আসে, তাহাকে এক রাত্রের সুখনিদ্রার চেয়ে বেশি মনে হয় না। গল্প যখন ফুরাইয়া যায়, আরামে শ্রান্ত দুটি চক্ষু আপনি মুদিয়া আসে, তখন তো শিশুর ক্ষুদ্র প্রাণটিকে একটি স্নিগ্ধ নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ স্রোতের মধ্যে সুষুপ্তির ভেলায় করিয়া ভাসাইয়া দেওয়া হয়, তার পরে ভোরের বেলায় কে দুটি মায়ামন্ত্র পডিয়া তাহাকে এই জগতের মধ্যে জাগ্রৎ করিয়া তোলে!

 কিন্তু যাহার বিশ্বাস নাই, যে ভীরু এ সৌন্দর্য্যরসাস্বাদনের জন্যও এক ইঞ্চি পরিমাণ অসম্ভবকে লঙ্ঘন করিতে পরায়ুখ হয়, তাহার কাছে কোনো কিছুর আর তারপরে নাই, সমস্তই হঠাৎ অসময়ে এক অসমাপ্তিতে সমাপ্ত হইয়া গেছে। ছেলেবেলায় সাতসমুদ্র পার হইয়া