পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬৪
বিচিত্র প্রবন্ধ

 টেনিস্‌ন্‌ যে idle tears, যে অকারণ অশ্রুবিন্দুর কথা বলিয়াছেন, মেঘদূত সেই বাজে চোখের জলের বাক্য। এই কথা শুনিয়া অনেকে আমার সঙ্গে তর্ক করিতে উদ্যত হইবেন। অনেকে বলিবেন, যক্ষ যখন প্রভুশাপে তাহার প্রেয়সীর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে, তখন মেঘদুতের অশ্রুধারাকে অকারণ বলিতেছেন কেন? আমি কি করিতে চাই না–এ সকল কথার আমি কোনো উত্তর দিব না। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি, ঐ যে যক্ষের নির্ব্বাসন প্রভৃতি ব্যাপার, ও সমস্তই কালিদাসের বানানো,–বাক্যরচনার ও একটা উপলক্ষ্যমাত্র। ঐ ভারা বাঁধিয়া তিনি এই ইমারত গড়িয়াছেন—এখন আমরা ঐ ভারাটা ফেলিয়া দিব। আসল কথা, “রম্যাণি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ নিশম্য শব্দান্‌” মন অকারণ বিরহে বিকল হইয়া উঠে, কালিদাস অন্যত্র তাহা স্বীকার করিয়াছেন; আষাঢ়ের প্রথমদিনে অকস্মাৎ ঘনমেঘের ঘটা দেখিলে আমাদের মনে এক সৃষ্টিছাড়া বিরহ জাগিয়া উঠে, মেঘদূত সেই অকারণ বিরহের অমূলক প্রলাপ। তা যদি না হইত, তবে বিরহী মেঘকে ছাড়িয়া বিদ্যুৎকে দূত পাঠাইত। তবে পূর্ব্বমেঘ এত রহিয়া-বসিয়া, এত ঘুরিয়া ফিরিয়া, এত যুথীবন প্রফুল্ল করিয়া, এত জনপদবধূর উৎক্ষিপ্ত দৃষ্টির কটাক্ষপাত লুটিয়া লইয়া চলিত না।

 কাব্য পড়িবার সময়ও যদি হিসাবের খাতা খুলিয়া রাখিতেই হয়, যদি কী লাভ করিলাম, হাতে হাতে তাহার নিকাশ চুকাইয়া লইতেই হয় তবে স্বীকার করিব মেঘদূত হইতে আমরা একটি তথ্য লাভ করিয়া পুলকিত হইয়াছি। সেটি এই যে, তখন মানুষ ছিল এবং তখনো আষাঢ়ের প্রথম দিন যথানিয়মে অসিত।

 কিন্তু অসহিষ্ণু বররুচি যাঁহাদের প্রতি অশিষ্ট বিশেষ প্রয়োগ করিয়াছেন তাঁহারা কি এরূপ লাভকে লাভ বলিয়াই গণ্য করিবেন? ইহাতে কি জ্ঞানের বিস্তার, দেশের উন্নতি, চরিত্রের সংশোধন ঘটিবে? অতএব