পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
পরনিন্দা
৭৩

মনুষ্যজাতিও নহে। মানুষকে বিধাতা এতই সৌখীন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন যে, যখন সে নিজের পেট ভরাইয়া প্রাণরক্ষা করিতে যাইতেছে, তখনও ক্ষুধানিবৃত্তি ও রুচিপরিতৃপ্তির যে সুখ, সেটুকুও তাহার চাই—সেই মানুষ ট্রামভাড়া করিয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়া পরের নিন্দা করিয়া আসিবে অথচ তাহাতে সুখ পাইবে না, যে ধর্ম্মনীতি এমন অসম্ভব প্রত্যাশা করে তাহা পূজনীয়, কিন্তু পালনীয় নহে।

 আবিষ্কারমাত্রেরই মধ্যে সুখের অংশ আছে। শিকার কিছুমাত্র সুখের হইত না, যদি মৃগ যেখানে-সেখানে থাকিত এবং ব্যাধকে দেখিয়া পলাইয়া না যাইত। মৃগের উপরেই আমাদের আক্রোশ আছে বলিয়াই যে তাহাকে মারি তাহা নহে, সে বেচারা গহন বনে থাকে এবং সে পলায়নপটু বলিয়া তাহাকে কাজেই মারিতে হয়।

 মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার, এত সুখ। আমি নাড়ী-নক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এ কথা শুনিলেই বোঝা যায়, সে ব্যক্তি জাতশিকারী। তুমি তোমার যে অংশটা দেখাইতে চাও না, আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি। জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি; আকাশের পাখীকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাঁধি—ইহা কত সুখের! যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায়, তাহাকে বাঁধা, ইহার জন্যে মানুষ কী না করে!

 দুর্লভতার প্রতি মানুষের একটা মোহ আছে। সে মনে করে, যাহা সুলভ তাহা খাঁটি নহে, যাহা উপরে আছে তাহা আবরণমাত্র, যাহা লুকাইয়া আছে তাহাই আসল। এইজন্যই গোপনের পরিচয় পাইলে সে আর কিছু বিচার না করিয়া প্রকৃতের পরিচয় পাইলাম বলিয়া হঠাৎ খুসি হইয়া উঠে। এ কথা সে মনে করে না যে উপরের সত্যের চেয়ে