পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মৃত্যু
৯৯

লোলুপ নিয়ত মম মন মধুকরে
যে নিত্য উদ্যানে সেই পুষ্প বিরাজিত,
হে মত্যু! তাহার তুমি শরণি নিশ্চিত।”

 মৃত্যু তাহার নিকট বিশ্বের পরপারে যাইবার সেতু!

 মত্যু-এ নাম শ্রবণ করিলে, সহসা হদৃয়ে ভীষণ আতঙ্কেরই উদ্রেক হয়? কিন্তু মত্যু যতই আমাদের অপ্রিয় হউক না কেন, ইহারই জন্য আমরা জীবনে সুখের আস্বাদ প্রাপ্ত হই। অদূরে প্রচণ্ড মার্তগুতাপ রহিয়াছে বলিয়াই স্নিগ্ধ বৃক্ষচ্ছায়া বা সুকোমল তৃণশয্যা আমাদিগের নিকট সুখোদায়ক। অন্ধতমসাচ্ছন্ন রজনীতে গৃহমধ্যে নির্বাণোন্মুখ কম্পমান সামান্য দীপশিখাও আমাদিগের নিকট স্নিগ্ধ বোধ হয়। মত্যু আছে বলিয়াই যশোগৌরবে বিমণ্ডিত হইবার আমাদিগের এতদূর আকাক্ষা! বিজয়মাল্যে বিভূষিত হইবার এরপ ঐকান্তিক ইচ্ছা! মত্যু আছে বলিয়াই অমরত্ব লাভের জন্য আমাদিগের এরপ প্রয়াস। বিসর্জ্জন আছে বলিয়াই আবাহনের প্রভাতী সঙ্গীত এরপ শ্রুতিসুখকর। মৃত্যুর সহিত জড়িত বলিয়াই আমাদিগের নিকট জীবন এত প্রিয়! জীবিত থাকিবার জন্য আমাদিগের এত প্রয়াস!—এত বাঞ্ছা! এত আয়োজন।

 ১২৭৭ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিবস কাশীধাম হইতে সংবাদ আসিল ঠাকুরদাসের জীবন সংকটাপন্ন। সংবাদপ্রাপ্তিমাত্রই বিদ্যাসাগর সর্ব্বকর্ম পরিত্যাগ করিয়া পিতৃপদসেবার নিমিত্ত কাশীযাত্রা করিলেন। এদিকে দীনবন্ধু ও শম্ভুচন্দ্র ভগবতী দেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া কাশীধামে গমন করিলেন। রীতিমত সেবা শুশ্রূষা ও ঔষধাদির সুব্যবস্থায় ঠাকুরদাস শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করিলেন। ১৫ই ফাল্গুন বিদ্যাসাগর, জননী ও সহোদরদিগকে পিতৃপরিচর্য্যার নিমিত্ত নিযুক্ত রাখিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলেন। ভগবতী দেবী ফাল্গুন, চৈত্র দুই মাস কাশীবাস করেন।

 ক্রমে চৈত্রসংক্রান্তি সমাগত হইল। কাশীধামে সে দিন মহোৎসব। বিশ্বের ও অন্নপূর্ণার মন্দির জনতায় পরিপূর্ণ। বিবিধ বাদ্যধ্বনিতে চতুর্দ্দিক মুখরিত! পুতহোমগন্ধে দশদিক আমোদিত। ‘হর’, ‘হর’, ‘বম্’, ‘বম্’ শব্দে চতুর্দ্দিক বিকল্পিত। কাশীধামে সে দিন উৎসবের আনন্দস্রোত প্রবাহিত হইয়াছে। ভগবতী দেবী প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করিয়া স্নান ও সন্ধ্যাবন্দনাদি সুসম্পন্ন করিলেন। তৎপরে দেবমন্দিরদি দর্শনাভিলাষে গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। ভক্তিসহকারে দেবদর্শন, মন্দিরাদি প্রদক্ষিণ ও দানাদি কার্য্য সুম্পন্ন করিয়া গৃহে প্রত্যাগত হইলেন। পরে স্বহস্তে রন্ধনাদি সমাপন করিয়া সকলকে ভোজন করাইলেন।

 ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত হইল। ভগবতী পুনরায় সন্ধ্যাকালীন আরত্রিক দর্শন মানসে বহির্গত হইলেন। দেবদর্শন ও প্রণামাদি করিয়া গৃহে পুনরায় প্রত্যাগত