পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম পরিচ্ছেদ॥ জন্ম ও বাল্যজীবন

 এই পৃথিবীর কত স্থানে কত সূর্য্যকান্তমণি, সূর্য্যকিরণব্যতিরেকে হীনপ্রভ হইয়া রহিয়াছে, কে তাহার গণনা করে! কত উদারচেতা নর-নারীর উন্নতচরিত্র আলোচনার অভাবে বিস্মৃতি-সলিলে বিলীন হইতেছে, কে বা তাহার সন্ধান রাখে। প্রতিভা ইহজগতে আদরণীয় ও পূজনীয়, এবং ইহা ঐশ্বরিক দান। করুণাময় জগদীশ্বর ধনীনির্ধননির্ব্বিকল্পে ও নরনারীনির্ব্বিশেষে এই স্বর্গীয় ধন সকলকে বিতরণ করেন। আমরা খনা, লীলাবতী প্রভৃতিতে বুদ্ধিগৌরবের পরাকাষ্ঠা দেখিয়া মুগ্ধ হই, রাণী ভবানী, অহল্যাবাই প্রভৃতিতে সেবাধর্ম্ম ও শাসন-নৈপুণ্য দেখিয়া পুলকিত হই, তারাবাই, দুর্গাবতী প্রভৃতিতে সামরিক কৌশল ও নীতিজ্ঞানের পরিচয় পাইয়া মুক্তকণ্ঠে তাঁহাদের যশোগানে প্রবৃত্ত হইয়া থাকি, এবং এই সকল আর্য্যরমণী নারীজাতির আদশভূতা ও স্বর্গস্থ দেবীসমাজের বরণীয়া বলিয়া গৌরবান্বিত হই, কিন্তু দরিদ্রের পর্ণকুটীরে প্রতিভার যে উন্মেষ, সে বিষয়ের পর্য্যালোচনায় আমরা সম্পূর্ণ উদাসীন। সেইজন্য মনে হয়, দরিদ্রের পর্ণকুটীরে প্রতিভার যে বিকাশ, তাহা বনজাত সুরভিকুসুম, সুগন্ধি গিরিশৈবাল ও অরণ্যসুলভ পরিমলপূর্ণ কস্তুরীর স্বকীয় গুণগৌরবের ন্যায় স্বস্থানেই স্বতঃ প্রকাশিত থাকে, জগৎ তাহার অনুসন্ধান করে না। ঊনবিংশ শতাব্দী বিধাতার কি শুভ আশীর্ব্বাদ শিরোধার্য্য করিয়া অবনীমণ্ডলে আবির্ভূত হইয়াছিল, তাহা বুধগণই বলিতে পারেন। কারণ, এই শতাব্দীতে জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোকে এবং ধর্ম্মের বিমল ও পবিত্র জ্যোতিতে বসুন্ধরা উদ্ভাসিত হইয়াছিল। এই শতাব্দীরই প্রথমার্দ্ধে কর্ম্মবীর ফ্রাঙ্কলিন, ওয়াসিংটন, ম্যাট্‌সিনি, গ্যারিবল্‌ডি, উইলবারফোর্স; ধর্ম্মবীর লিনকন ও থিওডোর পার্কার প্রভৃতির জননীগণ এবং সেবাব্রতধারিণী ফোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ভগিনী ডোরা, গ্রেস ডালিং, মেরি কার্পেণ্টার ও কুমারী কব প্রভৃতি মহিলাগণ পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অংশে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময়ে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই বঙ্গভূমির কোনও দরিদ্র ব্রাহ্মণের পর্ণকুটীরে এক নারীরত্ন জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। ইনিই আমাদের পুণ্যশ্লোক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা ভগবতী দেবী।

 এই বিশ্বের কি বিচিত্র বিধান! যে বংশে কোন মহাপুরুষ বা নারীরত্ন জন্মগ্রহণ করেন, পূর্ব্ব হইতেই সেই বংশ ঈশ্বরানুগৃহীত হইয়া থাকে। ভগবতী দেবী সম্বন্ধেও আমরা এই অশেষকল্যাণকর নিয়মের অনুক্রম দেখিতে পাই। তাঁহার পিতামহ একজন সত্যসন্ধ, ধর্মনিষ্ঠ, সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। পিতা মহাত্মা রামকান্ত তর্কবাগীশ জাহানাবাদ মহকুমার পশ্চিম সুপ্রসিদ্ধ গোঘাট গ্রামে বাস করিতেন। ইনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে ইঁহার