পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চিতাভস্ম
১০১

মাধুরী!—জীবাত্মা দেহ—পিঞ্জর হইতে ধীরে ধীরে পরমাত্মায় লীন হইতেছে!—এ মহাসঙ্গম! এ গম্ভীর দৃশ্য দেখিয়া ভাবে বিহ্বল হইয়া যাইতে হয়! যেন স্বতই মনে হয়, মা আনন্দময়ি!—এ কি তোমার বিচিত্র লীলা! শুনিয়াছি সাধ্বী সতী পতিব্রতা রমণীর হৃদয়ে তুমি আনন্দময়ীরপে সতত বিরাজ কর। মা! মরণেও তুমি আনন্দময়ীরূপে স্বপ্রকাশ! একি তোমার আনন্দের লীলা খেলা! —মা! তোমার তত্ত্ব কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।


একবিংশ পরিচ্ছেদ॥ চিতাভস্ম

 শ্মশান।—তুমি মানবের শেষ সদগতি—স্থল।—তুমি মহাপবিত্র পণ্য তীর্থক্ষেত্র! তোমার এখানে পণ্ডিত, মুর্খ, ধনী, নির্ধন, সুন্দর, কুৎসিত, মহৎ, ক্ষুদ্র—সংসারের এই ভেদজ্ঞান নাই! —তোমার এখানে স্বাভাবিক, কৃত্রিম; নৈসর্গিক, অনৈসর্গিক; পার্থিব, অপার্থিব;—এ সকল বৈষম্য নাই!—এমন সাম্যস্থান জগতে ত অন্বেষণ করিয়া পাই না!—সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান! —তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র! তোমার এখানে আসিলে, মনুষ্যজীবনের অসারতা উপলব্ধি হয়, —আত্মাভিমান সঙ্কুচিত হয়—স্বার্থপরতা দূরে পলায়ন করে —অশান্ত মানব ক্ষণেকের জন্য শান্ত মূর্ত্তি ধারণ করে!—সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান!—তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র। তোমার এখানে আসিলে মনে ঘোরতর বৈরাগ্যের উদ্রেক হয়!—কুলের অহঙ্কার, শীলের অহঙ্কার, সৌন্দর্য্যর অহঙ্কার, বিদ্যার অহঙ্কার, ধর্ম্মের অহঙ্কার, প্রভুত্বের অহংকার,—সকল অহঙ্কারই চূর্ণীকৃত হয়!—সকল অহঙ্কারই তোমার বক্ষে পড়িয়া চিতাভস্মে পরিণত হয়। সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান!—তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র!

 পুণ্যতীর্থ কাশীধামে, জাহ্নবীবক্ষে, মনিকর্ণিকায়, ঐ চিতা ধক্ ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে! ঐ চিতাগ্নিতে সতীর পবিত্র দেহ পড়িতেছে!—সৌন্দর্য্য পুড়িতেছে! বিশ্বপ্রেম পুড়িতেছে!—ওজস্বিতা, তেজস্বিতা; মনস্বিতা, দীনতা; মহানুভবতা, পরার্থপরতা; সহিষ্ণুতা পুড়িতেছে। মহত্ত্ব, মিতাচার; দয়া, পরোপকার; সৌজন্য, সদাচার; কর্ত্তব্যবুদ্ধি সমস্তই পুড়িতেছে! বিদ্যাসাগরের জীবনের জ্যোতিঃ পুড়িতেছে —এই সকলের সমষ্টি পুণ্যশীলা, দীনজননী ভগবতী দেবী পুড়িয়া ক্রমে চিতাভস্মে পরিণত হইতেছেন! মানবজীবনের ইহাই পরিণাম! জগতের ইহাই নিয়ম!

 জগৎ —অথাৎ যাহা যায়!—মানুষ জন্মে, আবার মরে!—পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ সকলেই জন্মে, আবার দুদিন পরে মরে!—বৃক্ষ, গুন্ম, লতা সকলেই জমে ও মরে।—নির্ম্মলসলিলা, প্রাণরূপিনী স্রোতস্বিনী, নয়নানন্দকর,