পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জন্ম ও বাল্যজীবন

ব্রহ্মদর্শন করেন, সেই ব্রহ্মের সেবার নিমিত্ত নরসেবায় নিযুক্ত থাকেন, আমরা সেই ব্রহ্মের স্বরূপ জানিয়া যদি প্রত্যেক মানবের সেবায় নিযুক্ত থাকি, তাহা হইলে মুসলমান, বৌদ্ধ প্রভৃতি পার্থক্য কোথায় থাকিবে? সেই সেবায় মুগ্ধ হইবে না এমন মানবদেহধারী কে থাকিতে পারে? অহিন্দু বলিয়া ঘৃণা করিলে পার্থক্য জন্মিবে, কিন্তু সেবাধর্ম্মে পার্থক্য কোথায়? এই সেবাধর্ম্মে ঘৃণা বিদ্বেষ তিরোহিত হইবে। যিনি সেবাধর্ম্ম গ্রহণ করিবেন, তিনি বুঝিতে পারিবেন যে, তিনি মনুষ্য—ব্রহ্ম তাঁহাতে বিরাজমান; সেই ব্রহ্ম প্রত্যক্ষ করিয়া অপরের সেবা করিবেন ও সেবা দ্বারা সেই সেব্য ব্যক্তিরও ব্রহ্ম উদ্দীপিত হইবেন।

 বাল্যকাল হইতেই ভগবতী দেবী মিতাচারিণী ছিলেন। সামান্য পদার্থকেও তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করিতেন না। এবং সেই সকল দ্রব্যের তিনি সদ্ব্যবহার করিতেন। বাল্য জীবনেই যেন তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, ক্ষুদ্র ও বহৎ লইয়াই এই সংসার। যেন তিনি প্রাণে প্রাণে বুঝিতে পারিয়াছিলেন,—নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাহার সম্পদ, অনন্ত হইতে অনন্ত যাঁহার সঞ্চয়, একটি শুষ্ক পত্র, চ্যুত পুষ্প, বিন্দুমাত্র জল, অথবা কণাপরিমাণ মৃত্তিকা যখন তাঁহার নিকট তুচ্ছ নহে এবং তিনি এই সকল বস্তুর মিতব্যয়ের বিধান করিয়া রাখিয়াছেন, তখন আমরা ক্ষদ্রাদপি ক্ষুদ্র মানব কোন সাহসে ও কি অহঙ্কারে সামান্য বস্তুকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া তাঁহার উচ্চ দানের অবমাননা করিব! এই মহান্ ভাব তাঁহার বালিকাহৃদয়ে উদ্দীপিত হইয়াছিল বলিয়াই বোধ হয়, তিনি সামান্য ভগ্ন মৃন্ময় পাত্রটি পর্যন্ত ফেলিয়া দিতে গেলে, বাধা দিয়া কাড়িয়া লইতেন এবং যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিতেন,—বিশ্বাস ইহা দ্বারা জগতের কোন মঙ্গল কার্য্য সাধিত হইবে।

 উৎকৃষ্ট অশন, বসন ও ভূষণে তাঁহার আদৌ স্পৃহা ছিল না। সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনেই তিনি পরিতুষ্ট হইতেন। তিনি যেন বাল্যজীবনেই উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, লালসারূপ বহ্নিশিখা কোন ক্রমেই প্রশমিত হয় না, নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হয় না,—উত্তরোত্তর উপচীয়মান হওয়াই ইহার ধর্ম্ম। সেই জন্য তিনি আত্মসুখ বিনিময়ে পরের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করিয়া সন্তোষরূপ পরমধন লাভ করিতে সতত যত্নবতী হইতেন।

 বাল্যজীবনে তাঁহার আর এক বিশেষত্ব—তাঁহার দীন ভাব। অহঙ্কার যেন ক্ষণেকের তরে তাঁহার চরণ পর্য্যন্ত স্পর্শ করিতে পারে নাই। প্রত্যুতঃ দীনতা মানব-চরিত্রের অত্যুজ্জ্বল অলঙ্কার। সংসার জীবনেও ইহার অদ্ভুত প্রভাব দৃষ্ট হয়। অহঙ্কারীকে সকলেই দ্বেষ করে; দীনতা সর্ব্বত্র জয়লাভ করে। আচণ্ডাল সকলে তাঁহার দীন চরিত্রে মোহিত হয়। ধর্ম্মজগতের ত কথাই নাই। পথিবীতে এ পর্য্যন্ত যত ধর্ম্মমত প্রচারিত হইয়াছে, তাহার মূলে দীনতা ও তৎসহচর সৎসাহস ও ঈশ্বরনির্ভরতাই রাজত্ব করিতেছে। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ সর্ব্বভূত-নিয়ামক হইয়াও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ব্রাহ্মণের পদপ্রক্ষালনে আপনাকে নিয়োজিত করিয়া