পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবাহ ও বধূজীবন
১৯

নারীর বিশুদ্ধ চরিত্রে দোষারোপ করিত, সে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হইত। আবহমান কাল হইতেই ভারতে নারীপূজা প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। এবং এই নারীপূজাই ভারতের এক অক্ষয়কীর্ত্তি।

 ভগবতী দেবীর বধূ জীবনের সেবাধর্ম্মের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এস্থলে উল্লেখ করিয়া আমরা এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি করিব।

 একদিন দিবা অবসানপ্রায়, এমন সময়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় শুষ্ককণ্ঠ এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ গৃহে অভ্যাগত হইলেন। সেদিন গৃহে অত্যন্ত অস্বচ্ছল অবস্থা। রাত্রে সন্তানগণ অর্দ্ধাশনে এবং পরদিন অনশনে দিবাযাপন করিবে, এইরূপই ব্যবস্থা হইয়া রহিয়াছে। ক্ষুধাতুর, তৃষ্ণাতুর ব্রাহ্মণ অতিথি গৃহে আগত, উপায় কি? কিছুক্ষণ পরে ভগবতীর শ্বশ্রূদেবী দরবিগলিতনেত্রে করযোড়ে অতিথিকে নিবেদন করিলেন, ‘মহাশয়, আমি অতি হতভাগিনী। আমি গৃহস্থ আশ্রমে থাকিয়া গার্হস্থ্যধর্ম্ম পালন করিতে পারিলাম না। অভ্যাগতের পরিচর্য্যায় বিমুখ হইলাম। আমার অরণ্যবাসই শ্রেয়ঃ। আমার সন্ততিগণ অনশনে নিশাযাপন করিবে, এইরূপ অবস্থা, আমি কিরূপ করিয়া অতিথি সৎকার করিব ভাবিয়া আকুল হইতেছি। দয়া করিয়া আমার অপরাধ গ্রহণ করিবেন না।” ভগবতী দেবী অন্তরাল হইতে এই কথা শুনিয়া অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না। শ্বশ্রূদেবী সমীপে ধীরে ধীরে গমন করিয়া মৃদস্বরে বলিলেন,—“মা, এরূপ ক্ষুধাতুর ও তুষ্ণাতুর অতিথিকে কখন প্রত্যাখ্যান করা হইবে না। যে কোন উপায়ে ইঁহার সৎকার করতেই হইবে। আপনি ইঁহাকে বসিতে আসন ও পাদ্যার্ঘ দিউন।” এই কথা বলিয়া তিনি হস্তে পরিহিত একগাছি পিত্তলের পৈঁছা উন্মোচন করিয়া একজন প্রতিবেশিনীর নিকট বন্ধক রাখিলেন এবং তদ্বিনিময়ে একসের তণ্ডুল গ্রহণ করিলেন। পরে সেই তণ্ডুলের একপুয়া নিকটস্থ কোন মুদীর দোকানে প্রেরণ করিয়া একপুয়া দাউল আনাইলেন। পরিশেষে, সেই দাউল ভাতে ভাত রাঁধিয়া অতিথি সৎকার করিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ভগবতী দেবীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও পরিচর্য্যায় এরপ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে, সেই ‘ডালভাতে ভাত’ পরম পরিতোষপূর্ব্বক ভোজন করিলেন। ব্রাহ্মণের ভোজনান্তে, ভগবতী শ্বশ্রূদেবীকে বলিলেন, “মা, আমাদের ত একখানি কুটীর মাত্র সম্বল। এখন কোন প্রতিবেশীর গৃহে ইঁহার শয়নের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া আসুন।” শ্বশ্রূদেবীও বধূর কথামত কার্য্য করিলেন। পরদিবস প্রভাতে শয্যা পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া ব্রাহ্মণ দুর্গাদেবীর গহপ্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং উপবীত দ্বারা হস্তদ্বয় সংবদ্ধ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বলিতে লাগিলেন,—“হে সবিতৃদেব! তুমি জগল্লোচন। জগতের ধর্ম্ম, অধর্ম্ম, পাপ, পুণ্য সমস্তই তুমি নিরীক্ষণ করিতেছ। এই বালিকা বধূর হৃদয়ে সেবাধর্ম্ম, দয়াদাক্ষিণ্য, স্নেহ, মমতা, অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর ন্যায় স্বতঃ প্রবাহিত হইতেছে, এ সমুদয় বিষয় তুমি