পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৬
ভগবতী দেবী

বলিলেন, “ভদ্রে! এখনও যদি শিশুর শিক্ষা আরম্ভ করিয়া না থাক, তবে এই চারি বৎসর বৃথা অতিবাহিত হইয়াছে।” জনক জননী ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সংসারে শিশু সন্তানগণের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন। জননীর উদার বা অনুদার প্রকৃতি, তাঁহার কুসংস্কার তমসাচ্ছন্ন অথবা দিব্য জ্ঞানালোক পরিস্ফুট প্রকৃতিনিচয়ই শিশুর জীবনপথের পরিচালক। সুতরাং মাতার এক একটি সদনুষ্ঠান বা অসদনুষ্ঠান, তাঁহার আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি, স্বভাব, চরিত্রের উপর শিশুর বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করিতেছে।

 পরিবার মধ্যে ধর্ম্ম ও সাধুতা রক্ষা করিবার ভার রমণীর হতে। জননী যদি ধর্ম্মপরায়ণা ও বিবেকশালিনী হন, তাঁহার অন্তরে যদি সাধুতা লাভের ইচ্ছা বলবতী থাকে, তাহা হইলে সন্তানগণও সেই সকল সদ্‌গুণ লাভ করে। স্নেহময়ী মাতার অধরনিঃসৃত সুমিষ্ট অনুশাসন বাক্য সন্তানের স্মৃতিপটে নিবদ্ধ হইয়া থাকে। বিদ্যালয়ের শত শিক্ষকের উপদেশে যে শিক্ষায় লাভ না হয়, একটি সুশিক্ষিত, সচ্চরিত্রা, সংযতচিত্তা, বিবেকপরায়ণা মাতার ক্রোড়ে বর্দ্ধিত হইলে, সন্তানদিগের সে শিক্ষা লাভ হইয়া থাকে। মহৎ লোকের জীবনচরিত পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, জগতে যত মহাজন যে যে সদ্‌গুণের জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া গিয়াছেন, অধিকাংশ স্থলে, এরপ পরিলক্ষিত হয় যে, তাঁহাদের জননীগণ এই সকল চরিত্র গুণে গুণবতী ছিলেন।

 ত্রিভুবনবিজয়ী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু নিরতিশয় হরিবিদ্বেষী ছিলেন। হরির নাম শুনিলেই তিনি ক্রোধে অধীর হইতেন। তাঁহার রাজ্যের চতুঃসীমাতেও কেহ হরিনাম উচ্চারণ করিতে পারিত না। এমন হরিদ্বেষী গৃহেও, হরিভক্তিপরায়ণ, রাজমহিষী কয়াধূর ভক্তির ফলে, প্রহ্লাদের আবির্ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। পঞ্চমবর্ষীয় শিশু এতদূর ধর্ম্মপরায়ণতা ও ভগবানের প্রতি আত্মনির্ভরের ভাব কোথায় শিক্ষা করিল? সকলেই জানেন, যে প্রেম কয়াধূর হৃদয়ে, অন্তঃসলিলা ফল্গু নদীর ন্যায় প্রবাহিত হইতেছিল, তাহাই পঞ্চমবর্ষীয় শিশু প্রহ্লাদের হৃদয়ে ভক্তিমন্দাকিনীতে পরিণত হইয়াছিল।

 উত্তানপাদ রাজার পত্র ধ্রুব, বিমাতা সুরুচির দুর্ব্বাক্য বাণে বিদ্ধ হইলে পর জননীর নিকটে উপস্থিত হইয়া অতি কাতর ভাবে ক্রন্দন করিতে করিতে সমস্ত বিষয় নিবেদন করিলে, ধর্মশীলা, সহিষ্ণু ও বিবেকপরায়ণা জননী সুনীতি, যে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহা অতি মহৎ, অতি উচ্চ। তিনি তাঁহাকে ক্রোড়ে লইয়া সান্ত্বনা করিয়া বলিয়াছিলেন “বৎস! কাঁদিও না; এই পৃথিবীতে মানুষ নিজ কার্য্যের গুণেই বড় হয়। যদি বিমাতার কথায় মনে অত্যন্ত ক্লেশ হইয়া থাকে, পুণ্যলাভ করিবার জন্য যত্ন কর; পুণ্যলাভ করিলে, সকল ফল লাভ হইবে। বিনয়ী, সত্যবাদী, ধর্ম্মপরায়ণ ও পরহিতব্রতী হও; জল যেমন নিম্নাভিমুখেই ধাবমান হয়, এই সকল গুণবিশিষ্ট হইলে, পথিবীর সর্ব্বসম্পদ অনায়াসেই তোমাকে