পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শিশুচর্য্যা ও সন্তানশিক্ষা
৩৫

কত ওজ, কত অমৃত নিহিত রহিয়াছে বলিয়া মনে করিতেন। অবশ্য সময়ে সময়ে এই আত্মবিশ্বাসের সহায়তা করায় শিশুদিগের দুই একটি ভুল ভ্রান্তি ঘটিত। কিন্তু তিনি বলিতেন যে−“এই ভুলটাই যে একটা মহা শিক্ষা।”

 লোকের দোষ অপেক্ষা গুণের উপরই তাঁহার অধিক লক্ষ্য ছিল এবং গুণের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া তাহার দোষকে গুণে পরিণত করিতে সতত চেষ্টা করিতেন। যেমন পাপীকে ‘পাপী’ ‘পাপী’ বলিলে, তাহার উদ্ধার অসম্ভব। তাহার ভিতর যে মহাশক্তি আছে, সেই দিকে তাহার দষ্টি আকর্ষণ করিয়া দিতে পারিলেই তাহার পক্ষে মঙ্গল হয়, সন্তানশিক্ষা সম্বন্ধেও ঠিক সেই ভাবেই তিনি কার্য্য করিতেন। কারণ তিনি যেন মনে করিতেন, জগতে পাপ তাপ নাই, রোগ শোক নেই, যদি কিছু পাপ জগতে থাকে তাহ। এই ভয়। যে কোন কার্য্য তোমার ভিতরে শক্তির উদ্রেক করিয়া দেয়, তাহাই পুণ্য; আর যাহাতে তোমার শরীর মনকে দুর্ব্বল করে, তাহাই দুর্ব্বলতা, মৃত্যু বা মহাপাপ। সুতরাং মত্যুর সহায়তা না করিয়া জীবনদান করাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার অর্থ-ধ্বংসসাধন নহে; প্রকৃত শিক্ষার অর্থ—গঠন। সুশিক্ষায় অন্তর্নিহিত শক্তির উপচয়ই হইয়া থাকে; শক্তির অপচয়ের কোন আশঙ্কাই থাকে না।

 বিদ্যাসাগর বাল্যকালে অতিশয় দুষ্ট ছিলেন। অনেক প্রতিভাবান প্রতিষ্ঠাশালী ব্যক্তির বাল্যজীবনে বালম্বভাবসুলভ চপলতার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য বাল্যকালে গঙ্গাতীরে ব্রাহ্মণগণের নৈবেদ্য কাড়িয়া খাইতেন; অমর কবি সেক্সপিয়র বাল্যকালে দুষ্ট বালকদিগের সঙ্গদোষে হরিণ চুরি করিয়াছিলেন। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের অত্যাচারে তাঁহার জননী জ্বালাতন হইতেন। বালক বিদ্যাসাগর বাল্যকালে পাড়ার লোকের বাগানের ফল পাড়িয়া চুপে চুপে খাইতেন; কেহ কাপড় শুখাইতে দিয়াছে দেখিলে, তাহার উপর মলমূত্র ত্যাগ করিতেন। প্রত্যহ পাঠশালায় যাইবার সময় মথুুর মণ্ডল নামক একজন প্রতিবেশীর দ্বারদেশে মলত্যাগ করিতেন। সকল সংবাদ মাতার কর্ণে প্রবেশ করিলে, তিনি বিদ্যাসাগরকে বলিলেন,—'বাপু, তুমি লোকের ছেঁড়া কাপড় দেখিলে, আপনার ভাল কাপড় তাহাকে পরাইয়া, নিজে সেই ছেঁড়া কাপড় পরিয়া বাটিতে আইস, লোকের দুঃখ দেখিলে তুমি মনে এত দুঃখ পাও, আর এরূপ করিয়া লোকের মনে ব্যথা দাও কেন? কোন খাদ্যদ্রব্য হস্তে তাহারা তোমার বিষ্ঠা স্পর্শ করিলে, সেই দ্রব্যগুলি তাহাদিগকে ফেলিয়া দিতে হয়, পুনরায় স্নান করিতে হয়। আহা, তাহাদের কত কষ্ট দেখ দেখি।” শুনা যায়, মাতার এরূপ শিক্ষায় সন্তানের সুফল ফলিয়াছিল। বালক বিদ্যাসাগর বলস্বভাবসুলভ চপলতাবশতঃ ঐরূপ অন্যায় কার্য্য করিতেন। কিন্তু যে দিন মাতার সুশিক্ষায় বুঝিতে পারিলেন, ঐ সকল অন্যায় কার্য্য হেতু লোকে নিগ্রহ ভোগ করে, তাহাদের মনে কষ্ট দেওয়া হয়, সেই দিন হইতেই তিনি ঐরূপ অন্যায় কার্য্য করিতে বিরত হইয়াছিলেন।