বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা
৩৭

পরিমাণে পরিস্ফুট দেখিতে পাই, তাহারও কারণ এই। এ সম্বন্ধে অপর দিকে মহাকবি ভবভূতির গভীরভাবপূর্ণ নিম্নলিখিত লোকটি আমাদের মনে পড়ে:

“বিতরতি গুুরঃ প্রাজ্ঞে বিদ্যাং ষথৈব তথা জড়ে
ন চ খলু তয়োর্জ্ঞানে শক্তিং করোত্যপহন্তি বা।
ভবতি চ তয়োর্ভূয়ান্ ভেদঃ ফলং প্রতি তদ্ যথা
প্রভবতি শুচির্বিদ্বেদগ্রাহে মণির্ন মৃদাং চয়ঃ।”

গুরু, সুবোধ এবং নির্ব্বোধ দ্বিবিধ ছাত্রকেই সমভাবে বিদ্যা বিতরণ করেন; কিন্তু তদুভয়ের ধারণাশক্তির বৃদ্ধি বা হ্রাস করিতে পারেন না। বিদ্যা-বিষয়ে যে পূর্ব্বোক্ত ছাত্রই প্রভূত পার্থক্য প্রাপ্ত হন, ইহা বলা বাহুল্য। নির্ম্মল মণিই প্রতিবিম্ব গ্রহণে সমর্থ হয়, মৃৎপিণ্ড কখনই সমর্থ হয় না।


পঞ্চম পরিচ্ছেদ॥ বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা

 তদানীন্তন কালে পাঠশালায় শিশুদিগের বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হইত। কিছু দিন পাঠশালে লিখিয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তানেরা টোলে ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করিতেন। এবং যাঁহারা সন্তানদিগকে রাজকার্য্য শিক্ষা দিতে প্রয়াস পাইতেন, তাঁহারা তাহাদিগকে পারসী পড়াইতেন। যাহারা জমিদারী সরকারে কর্ম্ম করিতে বা বিষয়-বাণিজ্যে নিযুক্ত হইতে ইচ্ছা করিত, তাহারাই শেষ পর্যন্ত গুরুমহাশয়ের পাঠশালে পাঠাভ্যাসে নিরত থাকিত।

 পাঠশালে পাঠনার রীতি এই ছিল যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণপরিচয় করিত। তৎপরে তালপত্রে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, শতকিয়া, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত। শেষে তালপত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত। তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘকালী প্রভৃতি শিখিত। সর্ব্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত। সে সময়ে শিক্ষাপ্রণালীর উৎকর্ষের মধ্যে এই ছিল যে, পাঠশালে শিক্ষিত বালকগণ মানসাঙ্ক সম্বন্ধে আশ্চর্য্য পারদর্শিতা দেখাইত। মুখে মুখে জটিল অঙ্কের সমাধান করিয়া দিতে পারিত। চক্ষের নিমিষে বড় বড় হিসাব পরিষ্কার করিয়া ফেলিত। হস্তাক্ষর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুমহাশয়দিগের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। তৎকালে বাঙ্গালা মুদ্রাযন্ত্র প্রায় ছিল না। যাহাদের হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা সংস্কৃত পুস্তক হস্তে লিখিত। হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইলে, তাহারা সাধারণের নিকট সম্মানিত হইত। এ কারণ অনেকে হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট করিবার জন্য বিশেষ যত্ন পাইত। তৎকালে এ প্রদেশে বিবাহসম্বন্ধ করিতে আসিলে, লোকে অগ্রে পাত্রের হস্তাক্ষর দেখিত, তৎপরে সম্বন্ধ স্থিরীকরণের ব্যবস্থা করিত।