পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৪
ভগবতী দেবী

বিদ্যাসাগর প্রায় সমস্ত দিন এই দয়াময়ী মহিলার দয়ার উপর নির্ভর করিয়া বিদেশে অবস্থিতি করিতেন। তাঁহারা স্নেহপূর্ব্বক তাঁহাকে খাবার দিতেন ও কথাবার্ত্তায় ভুলাইয়া রাখিতেন। বিদ্যাসাগর যখন জননী প্রভৃতির জন্য ভাবনা করিতেন, তখন ঐ রমণীদ্বয় ভুলাইয়া ও কত প্রকার গল্প বলিয়া সান্ত্বনা করিতেন এবং দেশের জন্য বা জননীর জন্য ভাবিতে দিতেন না। উক্ত রাইমণি দাসী ও জগদ্দুর্লভ সিংহের পত্নীর দয়াদাক্ষিণ্য গুণেই শৈশবকালে বিদ্যাসাগর সবিশেষ উপকৃত হইয়াছিলেন। তাঁহারা এরূপ দয়াদাক্ষিণ্য প্রকাশ না করিলে, বিদ্যাসাগরের কলিকাতায় অবস্থিতি করা দুষ্কর হইত। কারণ তখন সহরের স্বাস্থ্যের অবস্থা যেরূপ শোচনীয় ছিল, নৈতিক অবস্থাও তদপেক্ষা দূষণীয় ছিল। এস্থলে আমরা তাহার কিঞ্চিৎ আভাষ দিতেছি। তখন নাচ, যাত্রা, কবি, হাফআখড়াই, পাঁচালী, বুলবুলের লড়াই প্রভৃতি বিবিধ কৌতুকপ্রদ আমোদ তদানীন্তন বঙ্গসমাজের আচার পদ্ধতির মধ্যে বিধিবদ্ধ ছিল। বুলবুলের লড়াই দেখা ও ঘুড়ী উড়ান সেই সময়ে সহরের ভদ্রলোকদিগের এক মহা আনন্দের বিষয় ছিল। এক একটা স্থানে লোহার জাল দিয়া বেষ্টন করিয়া বহুসংখ্যক বুলবুলি পক্ষী রাখা হইত এবং মধ্যে মধ্যে ইহাদের মধ্যে লড়াই বাধিয়া দিয়া কৌতুক দেখা হইত। সেই কৌতুক দেখিবার জন্য সহরের লোকের জনতা হইত। ঢাউস ঘুড়ী, মানুষ ঘুড়ী প্রভৃতি ঘুড়ীর প্রকার ও প্রণালী বহুবিধ ছিল। এবং সহরের ভদ্রগৃহের নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণ গড়ের মাঠে গিয়া ঘুড়ীর মেলা দেখিতেন।

 এতদ্ভিন্ন সেই সময়ে অন্যান্য কৌতুকময় প্রথাও প্রচলিত ছিল। কোন কোন স্থানে সন্দেশের মজ্‌লিস্‌ অর্থাৎ গোল্লা বিছাইয়া তাহার উপর বসিয়া বৈঠকী সঙ্গীত হইত। কোন কোন স্থানে মানুষ পক্ষীর সভা অর্থাৎ বৃহৎ বৃহৎ পিঞ্জর মধ্যে মনুষ্য পক্ষিস্বরূপ অবস্থিতি করিত। আমোদ ক্ষেত্রে সেই সকল পিঞ্জর আনীত হইলে, কেহ কাক, কেহ কাঁদাখোঁচা, কেহ সারস, কেহ বক, এইরূপ নানাবিধ পক্ষীর প্রকৃতি দেখাইত, এবং মধ্যে মধ্যে পক্ষীর অব্যক্তস্বরে গান করিত।

 জননীর স্নেহ ও ভালবাসা হইতে দূরে থাকিয়া এই সকল নীচ আমোদপ্রিয় পুরুষ দলবেষ্টিত সহরে আসিয়া বাস করিতে হইলে, সিংহ পরিবারের ন্যায় পরিবার মধ্যে আশ্রয় লাভ করা অতীব সৌভাগ্যের বিষয় মনে করিতে হইবে। সিংহ পরিবারের স্নেহ ও ভালবাসা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে কি মহা ইষ্ট সাধন করিয়াছিল, তাহা বাক্যে বর্ণনা করিতে পারা যায় না। উত্তরকালে যাঁহারা বঙ্গদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, তাঁহাদের অনেকে নারীগণের এইরূপ অযাচিত স্নেহ পাইয়া মানুষকে ভালবাসিতে শিখিয়াছিলেন। এই সিংহ পরিবারের রাইমণি প্রবাসে বিদ্যাসাগরের মাতৃস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহার অনুপম স্নেহ ও যত্নের দ্বারা তিনি কি পরিমাণে বিদ্যাসাগরের হৃদয়