পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ॥ পারিবারিক জীবন

 পারিবারিক বন্ধন মানবজাতির অশেষ কল্যাণ ও সুখের নিদানস্বরূপ। পারিবারিক সম্বন্ধই মানবজীবন ও পশুজীবনে প্রভেদের পরিচায়ক, এবং পারিবারিক দায়িত্বজ্ঞান বা দায়িত্বহীনতাই, মানবচরিত্রকে দেবভাবে সম্বর্ধিত বা পশুভাবে পরিণত করে। ইহসংসারে যিনি পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ নহেন, তাঁহার চরিত্রপরীক্ষার উপযুক্ত স্থল কোথায়? ইহসংসারে যাঁহার আপনার বলিতে কেহই নাই, এই সুখময় ভূমণ্ডল তাঁহার নিকট যে দুঃখময় জীর্ণ অরণ্যবৎ প্রতীয়মান হইবে, তাহাতে আর বিচিত্র কি? মানবের পরিজনবেষ্টিত সংসার সত্য সত্যই তদীয় সুখ ও সদ্গতির লীলাভূমিস্বরপ। পারিবারিক বন্ধনই মনুষ্যহৃদয়ে প্রকৃত বল ও শক্তির সঞ্চার করিয়া থাকে, এবং পরিবারস্থ সকলের পরিচর্য্যা দ্বারাই মানবচরিত্রের উৎকর্ষলাভ ঘটে।

 হৃদয়ের উদারতাই মানবের সভ্যতার পরিচায়ক। সেইরূপ, যেখানে হৃদয়ের ক্ষুদ্রতা ও সকীর্ণতা, সেইখানেই অজ্ঞানতা ও অসভ্যতার আধিপত্য। মানুষ যতদিন এই অজ্ঞানান্ধকারে থাকে, ততদিন তাহার চারিধারের এই বহুর মধ্যে সে সেই এককে দেখিতে পায় না। মানবসমাজের এই অসংখ্য খণ্ডতার মধ্যে চিরদিন যে মহতী একতা বিরাজ করিতেছে, তাহা উপলদ্ধি ও অনুভব করিতে সে অসমর্থ। সেইজন্য, আপনার মোহবশে সে তাহার চতুর্দ্দিকের এই বৃহৎ জগতকে, এই বিপুল মানব সমাজকে সঙ্কীর্ণ ও ক্ষুদ্র করিয়া তাহার আপন ধারণার ও হৃদয়ের উপযুক্ত করিয়া লয়। কিন্তু, ক্রমে তাহার জ্ঞান যতই পরিস্ফুট হইয়া উঠে, প্রাণ যতই প্রসারিত হইতে থাকে, ততই সে তাহার সেই ক্ষুদ্র জগতের সীমার গণ্ডীকে বিস্তৃত ও বৃহৎ করিয়া তুলে। এই ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশই সংসারের নিয়ম। এই নিয়মের বশে মনুষ্যহৃদয় তাহার আপন ক্ষুদ্র সীমা অতিক্রম করিয়া, ক্রমে পরিবারের, তাহার পর গ্রামের, তাহার পর প্রদেশের, তাহার পর দেশের ও অবশেষে জগতের সকলেরই মধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। তখন তাহার চতুর্দ্দিকের এই অসংখ্য দেশকে সে একই পৃথিবী বলিয়া উপলদ্ধি করে, এবং বহুবর্ণে, ধর্ম্মে ও আচার ব্যবহারে পৃথগ্‌ভূত এই অগণ্য মানবসমাজকে তাহার আপন সমাজ বলিয়া সে স্বীকার করে। তখন এই পৃথিবীর সকল দেশই তাহার স্বদেশ, সকল জাতিই তাহার স্বজাতি। এই উদারতা, এই সভ্যতাই উন্নতির চরম আদর্শ।

 মহাজনগণের কথা স্বতন্ত্র। যাহারা বিশ্বপ্রেমিক, দিব্যজ্ঞানালোকে যাঁহাদিগের চক্ষু জ্যোতিষ্মান, বসুধাকে যাঁহারা আপনার বলিয়া মনে করিতে পারিয়াছেন, যাঁহারা ‘অয়ং নিজঃ পরোবেতি’ গণনা বিস্মৃত হইয়া, সাধনার বলে ধৃতি, ক্ষমা সহিষ্ণুতা চরিত্রগত করিয়াছেন, ইহসংসারে শোণিতসম্পর্কবিচার তাহাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করি না। কারণ, তাঁহারা স্বজাতি বা পৃথিবীর সমস্ত