পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
লোকানুরাগ ও সেবাধর্ম্ম
৬৯

অন্নসত্র ছিল, সেই সময়ে তিনি মাসে প্রায় একবার করিয়া বাটীতে আগমন করিতেন।

 অনেক নিরুপায় দরিদ্র লোক, ছোট ছোট বালক বালিকাগকে ঐ অন্নসত্রে ফেলিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করে। এই বালক বালিকাগণের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকজন লোক নিযুক্ত করা হয়। অন্নসত্রে গর্ভবতী কয়েকটি স্ত্রীলোক প্রত্যহ ভোজন করিত। প্রসবের পর তাহাদিগের নবপ্রসূত সন্তানগণের দুধ ও প্রসূতির পথ্যের ব্যবস্থা হয়। কিছুদিন পর ঐ প্রসূতিদের মধ্যে একটি মৃত্যুমুখে নিপতিত হইলে, উহার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক নিযুক্ত হয়। ঐ সন্তানের ১৭ বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করা হইয়াছিল। অন্নসত্র খুলিবার প্রথমাবস্থায় দেখা গিয়াছে যে, কেহ কেহ স্বীয় প্রাণসম সন্তানগণের হস্তধারণপূর্ব্বক স্বয়ং সমস্ত খাইয়া ফেলিত। তৎকালে কেহ কাহারও প্রতি স্নেহ মমতা করিত না। সকলেই সতত স্ব স্ব উদরের জ্বালায় বিব্রত ছিল। কিছুদিন পরে ঐ ভাব তিরোহিত হইয়া যায়। অন্নসত্রে ভেজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা দেখিয়া, দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোককে স্পর্শ করে এই আশঙ্কায় দুর হইতে তৈল দিত। ইহা দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। নীচ বংশোদ্ভবা স্ত্রীজাতির প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরূপ দয়া দেখিয়া, তাহারা পরম আহ্লাদিত হইয়াছিল এবং কর্ম্মচারিগণ তাঁহার এরূপ দয়া অবলোকনে, তদবধি উহাদিগকে স্পর্শ করিতে ঘৃণা করিত না। পরিবেশনের সময় বিদ্যাসাগর স্বয়ং পরিবেশন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন দেখিয়া, উপস্থিত ভদ্রলোকেরাও যোগ দিতেন।

 অন্নসত্রে যাহারা ভোজন করিত, তাহারা বিদ্যাসাগরের নিকট প্রকাশ করিয়া বলে, “মহাশয়! প্রত্যহ খেচরান্ন খাইতে অরুচি হয়, সপ্তাহের মধ্যে একদিন অন্ন ও মৎস্য হইলে আমাদের পক্ষে ভাল হয়। একারণ প্রতি সপ্তাহে একদিন অন্ন, পোনা মৎস্যের ঝোল ও দধি হইত। ইহাতে ব্যয় বাহুল্য হওয়ায় বিদ্যাসাগর অকাতরে যথেষ্ট টাকা বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। পুর্ব্বে দেশস্থ লোক মনে করিত যে, বিদ্যাসাগর বিদ্যোৎসাহী, একারণ দরিদ্র বালকদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ও রাখাল-স্কুল স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু তিনি দরিদ্রগণের প্রতি এতদূর দয়াল ছিলেন, তাহা কেহই জানিত না। এই অবধি সকলে তাঁহাকে বলিত যে, ইনি দয়াময় অথবা দয়ার সাগর। নীচজাতীয় স্ত্রীলোকদের মাথায় স্বয়ং তৈল মাখাইয়া দেন, ইনি ত মানুষে নন—সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৎকালে ঐ প্রদেশে সকলেই এই কথার আন্দোলন করিতে লাগিল।