পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সন্তানবাৎসল।
৮৫

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তৃতীয় ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ উপলক্ষ্যে বাটী যাইবার জন্য তাঁহার প্রতি জননীর সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ ছিল। সেই সময়ে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কর্ম্ম করিতেন। মাতৃ-আজ্ঞা পালন করবার জন্য তিনি উপরিতন কর্ম্মচারী মার্সেল সাহেবের নিকট ছুটির প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু ছুটি পাইলেন না। ছুটি না পাইলে, মাতার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা হইবে; এই দুঃখে মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর কিছুক্ষণ নীরবে রোদন করিলেন। পরে মাতার আজ্ঞা পালন করা কর্ত্তব্য স্থির করিয়া, পদত্যাগপত্র হস্তে সাহেবের নিকট উপস্থিত হইলেন। সাহেব তদ্দর্শনে বিস্মিত হইয়া ছুটি দিতে আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। দুটি পাইয়া তদ্দণ্ডেই ভৃত্য সমভিব্যাহারে বিদ্যাসাগর গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। এদিকে ঘোর বর্ষাকাল। আকাশ ঘন ঘটায় আচ্ছন্ন, সম্মুখে উচ্ছলিত ভয়াবহ দামোদর নদ, পারের কোন উপায় নাই। কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মাতৃভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র, জননীর চরণ স্মরণ করিয়া সেই প্রবল স্রোতোমালাবিশিষ্ট ভয়াবহ দামোদর নদ সন্তরণপূর্ব্বক পার হইলেন। পথে তাঁহাকে দারুকেশ্বর নদও এইরপে উত্তীর্ণ হইতে হইয়াছিল। এবং আর্দ্র বস্ত্রে দৌড়িতে দৌড়িতে বাটী গিয়া উপস্তি হইলেন। দেখিলেন, ভ্রাতা বিবাহ করিতে গিয়াছেন; তিনি বাটী যান নাই বলিয়া মাতৃদেবী গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া ক্রন্দন করিতেছেন। গৃহপ্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হইয়া উচ্চৈঃস্বরে ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পুত্রবৎসলা জননী তাঁহার কণ্ঠস্বর শ্রবণমাত্র শশব্যস্ত হইয়া বাহিরে আসিলেন। মাতা ও পুত্র উভয়ে উভয়কে তদবস্থ দেখিয়া এক সঙ্গে রোদন করিতে লাগিলেন। সে রোদনের আর নিবৃত্তি নাই! কি অপূর্ব্ব স্বর্গীয় দৃশ্য! কি অপূর্ব্ব সম্মিলন!

 বহুতর বিদেশীয় মাতৃভক্ত মহাপুরুষের কথা শুনা যায়, কিন্তু তাঁহাদের সহিত মাতৃভক্ত বীর বিদ্যাসাগরের তুলনা সম্ভবে কি? ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রোমের প্রসিদ্ধ সেনাপতি এবং সম্রাট জুলিয়াস্ সীজর যখন ইংলণ্ড বিজয়মানসে সাগর পার হইবার জন্য অর্ণবপোতে সসৈন্যে আরোহণ করেন, তখন ভয়ানক ঝড় বৃষ্টি উপস্থিত হইয়াছিল। প্রবল বাত্যাবিক্ষোভিত সিন্ধুর প্রলয় মূর্ত্তি দর্শনে নাবিকগণ ভীত হইলে, সীজর সদর্পে বলিয়াছিলেন, “ভয় নাই, এ তরি সীজরের সৌভাগ্য বহন করিতেছে।” পাঠকগণ! স্থিরচিত্তে প্রনিধান করুন এই দুই বীরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? একপক্ষে ভাবী বিজয়দপ্ত হৃদয়ের দুঃসাহসিকতা,—অপর পক্ষে মাতৃভক্ত বীরের মাতৃপূজার জন্য আত্মবলিদান! কোন্ বীর পুজার যোগ্য? কোন্ বীর প্রশংসনীয়? কোন বীর প্রাতঃস্মরণীয়?

 পাঠকগণ! ধর্ম্মজগতে এইরুপ ব্যাপারই একদিন সংঘটিত হইয়াছিল বটে। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ ভূভারহরণজন্য হরিবিদ্বেষী দুর্ব্বৃত্ত কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করিলে, পিতা বসুদেব যখন পাপাত্মার হস্ত হইতে সন্তানকে রক্ষা করিবার জন্য সেই সদ্যোজাত শিশুকে বক্ষে ধারণ করিয়া পলায়ন সময়ে কালিন্দী তটে আসিয়া