বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮
ভগবতী দেবী

কর্ত্তব্যবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া নানক পাঞ্জাবে একেশ্বরবাদ প্রচার করিতে গিয়া কোন প্রকার বাধাবিঘ্নে, ভ্রুক্ষেপ করেন নাই; শ্রীচৈতন্য শান্তিপুরে ইষ্টকবৃষ্টির মধ্য দিয়া হরিনাম কীর্ত্তন করিতে করিতে গমন করিয়াছিলেন; রাজা রামমোহন রায় প্রাণহানির সম্ভাবনা সত্ত্বেও অকুণ্ঠিতচিত্তে উদ্দেশ্যপথে অগ্রসর হইয়াছিলেন, সেই কর্ত্তব্যজ্ঞান প্রণোদিত হইয়া কর্ম্মবীর বিদ্যাসাগর কর্ত্তব্যকার্য্য সম্পাদনার্থ যে মন, প্রাণ, ধন, সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করিবেন ইহাতে আর বিচিত্র কি? বিধবাবিবাহ ব্যাপারে তাঁহার অসাধারণ অধ্যবসায়, আত্মোৎসর্গ, অবিশ্রাত পরিশ্রম ও বিশাল করুণ হৃদয়ের জন্য মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা না করিয়া কেহই নিরস্ত থাকিতে পারেন না। বিধবাদিগের বিবাহ দিতে প্রচুর ব্যয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়েন। প্যারিচরণ সরকার প্রমুখ কতিপয় দেশবিখ্যাত ব্যক্তি, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, বিদ্যাসাগরের অজ্ঞাতসারে, তাঁহার ঋণজাল মোচনের জন্য, চাঁদা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ইহা জানিতে পারিয়া বলিলেন, “আমার ঋণ আমিই পরিশোধ করিব, তাহার জন্য অন্য কাহাকেও দায়ী করিতে চাহি না।”

 এই বিধবাবিবাহ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যে কত নির্য্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। তিনি সেই সকল নির্যাতন ধীর ভাবেই সহ্য করিয়াছিলেন। শিষ্টসমাজের বিরাগ বহন করা দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে সেরুপ কঠিন নহে। কারণ, উহাদিগের ক্রোধও কখন বিবেক বা ব্যবহার মর্যাদা অতিক্রম করে না; এবং দেশকালপাত্র বিবেচনায়, অন্যের উপর রোষপ্রকাশ করিতেও ভীত হয়। কিন্তু যখন শিষ্টজনের এই ভীরু কোপানলে, ইতর লোকের রোষোচ্ছ্বাস আসিয়া সম্মিলিত হয়, যখন মূর্খ ও ইতরজনের ক্রোধবহ্নি উদ্দীপিত হয়, এবং সমাজতলস্থ অজ্ঞানান্ধ পশুপ্রকৃতি উত্তেজিত হইয়া ভীষণ গম্ভীরনাদ করিতে থাকে, তখন কেবল মহৎ ঔদার্য্য ও ধর্ম্মপ্রাণতাই, দেবতার ন্যায়, উহার প্রতি অব্যাকুল দষ্টিপাত করিতে সমর্থ হয়, এবং উহাকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করিতে পারে।


সপ্তদশ পরিচ্ছেদ॥ ক্ষমা ও সহিষ্ণতা

 ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা সাধুজীবনের বিশেষ লক্ষণ। এই দুইটি সদগুণে লোকের চিত্ত যেরূপ আকৃষ্ট হয়, এরূপ আর কিছুতেই হয় না। অপরে যখন আমাদিগের কোন অনিষ্ট সাধন করে, অথবা আমাদিগকে নানা প্রকারে উৎপীড়িত করিবার প্রয়াস পায়, তথন বৈর-নির্যাতন বাসনায় হৃদয় কলুষিত করা আমাদিগের পক্ষে নিতান্ত অনুচিত। যারা সহিষ্ণুতাশূন্য হইয়া ক্রোধে উত্তেজিত হয়, সেই আত্মসংযম-শক্তিবিরহিত ব্যক্তিবর্গের প্রকৃতি অতিশয় ঘৃণার্হ। আত্মসংযম-ক্ষমতাই