পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা
৮৯

মহত্ত্বের পরিচায়ক। কেহ আমাদিগের অপবাদ ঘোষণা করিলে, সাধারণতঃ তাহার প্রতি আমরা ক্রদ্ধ হইয়া থাকি, কেহ আমাদিগের প্রতি অত্যাচার করিলে, তাহার বিপৎকালে আমরা আনন্দ অনুভব করি; কিন্তু এই সকল ব্যাপার, আমাদিগের লঘুচিত্ততারই সাক্ষ্যদান করিয়া থাকে। সামান্য বায়ুভরে তৃণই বিচলিত হয়; ভয়ঙ্কর ঝটিকার সময়েও অচলরাজি স্থানচ্যুত হয় না। সামান্য কারণেই লঘু, হৃদয় বিচলিত ও অসহিষ্ণু হইয়া পড়ে, কিন্তু মহৎ হৃদয় কিছুতেই ক্রোধ বা বৈরনির্যাতনবাসনা দ্বারা চঞ্চল ও বিকৃত হইয়া পড়ে না।

 যাহারা ক্রোধপরতন্ত্র হইয়া, অত্যাচারীর দণ্ডবিধান করিতে অগ্রসর হয়, তাহারা দণ্ড প্রদান করিবার প্রকৃত অধিকারী নহে; কিন্তু প্রশান্ত হৃদয়ে অপরাধীর কল্যাণসাধনকামনায় যাঁহারা দণ্ডবিধান করিতে পারেন, তাঁহারাই কেবল শাসন ও দণ্ডবিধানের অধিকারী। যে সকল ব্যক্তি ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণ নহে, অপরকে শাসন করিবার অধিকার গ্রহণ করা তাহাদিগের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত কি? মানবমাত্রেরই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। ক্ষমাতে একদিকে যেমন হৃদয়ের উদারতা প্রকাশিত হয়, অপরদিকে তেমনই দয়া ও লোকানুরাগ প্রদর্শিত হইয়া থাকে। আমরা যদি ক্রমাগত আমাদিগের শত্রুগণের প্রতি ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিতে থাকি, তাহা হইলে কোন না কোন দিন তাহাদিগের হৃদয় অনুরাগে আর্দ্র হইয়া পড়িবে। শত্রুবিজয়ের এরূপ সহজ ও সুন্দর পন্থা আর কুত্রাপি দৃষ্টিগোচর হয় না।

 বিধবাবিবাহবিষয়ে গ্রামবাসিগণের মধ্যে যাঁহারা বিরোধী ছিলেন, তাঁহারা সুযোগ পাইলেই ঠাকুরদাসের উপর অত্যাচার করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। একদিন প্রাতে উঠিয়া ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেখিতে পাইলেন, রজনীযোগে বিরুদ্ধবাদীরা কণ্টকবৃক্ষের শাখা প্রশাখা স্তুপাকার করিয়া তাঁহাদের দ্বারদেশ রুদ্ধ করিয়া গিয়াছে। অতি কষ্টে ঠাকুরদাস ও ভগবতী গমনাগমনের জন্য নীরবে পথ পরিষ্কার করিয়া লইলেন। একদিন প্রাতে উঠিয়া দেখিলেন, বিপক্ষ দলের লোকেরা কতকগুলি মৃত জীব জন্তু তাঁহাদের দ্বারদেশে নিক্ষিপ্ত করিয়া গিয়াছে। ঠাকুরদাস সেই সময়ে একখানি গৃহ নির্ম্মাণের আয়োজন করিতেছিলেন। একদিন রজনীতে সুযোগক্রমে শত্রুপক্ষীয়েরা সেই গৃহের সমস্ত উপাদান অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিল। এইরূপে ঠাকুরদাস ও ভগবতী তাহাদিগের উৎপীড়নে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এই সংবাদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শ্বশুর, ক্ষীরপাইনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের নিকট প্রেরিত হইলে, তিনি একদিন বীরসিংহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য অতিশয় তেজস্বী, ক্রোধী ও বলশালী ছিলেন। তৎকালে তাঁহার স্বীয় গ্রামে ও পার্শ্বর্বত্তী গ্রামসমূহে তাঁহার বলবত্তার তুলনা ছিল না। অথচ তিনি সহায়তা ও উদারতা গুণে সর্ব্বজনের ভক্তি ও প্রীতি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের ভয়ে তৎকালে ঐ প্রদেশের