পাতা:বিদ্যাসাগর (বিহারীলাল সরকার).pdf/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সুযোগ পাইয়া তিনি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিবার চেষ্টা পাইলেন। এই পদে তর্কবাচস্পতি মহাশয় যাহাতে নিযুক্ত হন, তাহার জন্য তিনি মার্সেল্ সাহেবকে অনুরোধ করেন। বিদ্যারত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন, “যখন সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই পদ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করেন, তখন তিনি বলেন, মহাশয়, টাকার প্রত্যাশা করি না, আপনার অনুগ্রহ থাকিলেই, আমি চরিতার্থ হইব।” বিদ্যাসাগর মহাশয় এরূপ চাটুবাক্য প্রয়োগ করিবেন, তাঁহার জীবন-সমালোচনা করিলে এরূপ সিদ্ধান্ত করিতে সাহস হয় না। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, প্রকৃত প্রতিশ্রুতির কথা বলিলে সাহেব হয়তো তাঁহাকে অহঙ্কারী মনে করিবেন, সুতরাং কথা রক্ষার সম্ভাবনা থাকিবে না, তাই তিনি সাহেবকে এইরূপ তুষ্টিকর কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর আত্মগোপন করিয়া সাহেবের তুষ্টিকর কথা বলিবেন, এ কথায় বিশ্বাস করিতে কাহারও প্রবৃত্তি হইবে না; আর মার্সেল্ সাহেবও আত্মতুষ্টিকর কথায় বিমূঢ় হইয়া পড়িবেন, এ ধারণাও আমাদের নাই। যাহা হউক, মার্সেল্ সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায় তর্কবাচস্পতি মহাশয়কেই উক্ত পদে নিযুক্ত করিতে চাহেন। যে দিক্ দিয়াই হউক, ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বার্থত্যাগের সজীব সঙ্কেত। এরূপ প্রলোভন পরিত্যাগ করিতে একটু হৃদয়-বলের প্রয়োজন। জর্ম্মণ পণ্ডিত হীনের জীবনী-পাঠে তদানীন্তন মনস্বী রঙ্কিনের এইরূপ স্বার্থত্যাগের পরিচয় পাওয়া যায়। রঙ্কিনকে একবার একটী উচ্চ পদ দিবার প্রস্তাব হয়, তিনি কিন্তু হীনকে ঐ পদের উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া উক্ত পদ তাঁহাকেই দিবার জন্য অনুরোধ করেন। এই ব্যাপার কেবল বিদ্যাসাগরের স্বার্থত্যাগের পরিচয় নহে; প্রতিশ্রুতি-রক্ষা করিতে তাঁহাকে কিরূপ কঠোরতা সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহারও প্রমাণ পাইবেন।

 যে সময়ে তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে নিযুক্ত করিবাব কথা হয়, সেই সময়ে তর্কবাচস্পতি মহাশয় অম্বিকা কাল্‌নায় অবস্থিতি করিয়া তেজারতীর “কারবার” করিতেছিলেন; এতদ্ব্যতীত তথায় তাঁহার একটী টোলও ছিল। তাঁহাকে সোমবারে প্রয়োজন; কিন্তু শনিবারে কথা হয়। পত্র পাঠাইলে সময়ে পত্র পৌঁছিবার সম্ভাবনা নাই; পৌঁছিলেও তর্কবাচস্পতি মহাশয় এ কার্য্য স্বীকার করিবেন কি না, তাহার স্থিরতা ছিল না। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই দিনই একজন আত্মীয়কে সঙ্গে লইয়া কালনাভিমুখে যাত্রা করেন। কলিকাতা হইতে কালনা ২৪।২৫ ক্রোশ দূর। তিনি ও সেই সঙ্গী আত্মীয় সারারাত পদব্রজে চলিয়া পরদিন তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বাটীতে উপস্থিত হন।