বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৯).pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সাংখ্যদর্শন
১১৭

শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা তুমি গ্রহণ করিলে, তাহাতে তোমার দুঃখ। অতএব প্রকৃতি ভিন্ন কোন দুঃখ নাই। কিন্তু প্রকৃতিঘটিত দুঃখ পুরুষকে বর্ত্তে কেন? “অসঙ্গোঽয়ম্পুরুষঃ।” পুরুষ একা, কাহারও সংসর্গবিশিষ্ট নহে (১ অধ্যায় ১৫ সূত্র)। অবস্থাদি সকল শরীরের, আত্মার নহে (ঐ, ১৪ সূত্র)। “ন বাহ্যান্তরয়োরুপরজ্যোপরঞ্জকভাবোঽপি দেশব্যবধানাৎ শ্রুঘ্নস্থপাটলিপুত্ত্রস্থয়োরিব।” বাহ্য এবং আন্তরিকের মধ্যে উপরজ্য এবং উপরঞ্জক ভাব নাই; কেন না, তাহা পরস্পর সংলগ্ন নহে; দেশব্যবধানবিশিষ্ট। যেমন একজন পাটলীপুত্র নগরে থাকে, আর একজন শ্রুঘ্ননগরে থাকে, ইহাদিগের পরস্পরের ব্যবধান তদ্রূপ। পুরুষের দুঃখ কেন?

 প্রকৃতির সহিত সংযোগই পুরুষের দুঃখের কারণ। বাহ্যে আন্তরিকে দেশব্যবধান আছে বটে, কিন্তু কোন প্রকার সংযোগ নাই, এমত নহে। যেমন স্ফাটিকপাত্রের নিকট জবা কুসুম রাখিলে, পাত্র পুষ্পের বর্ণবিশিষ্ট হয় বলিয়া, পুষ্প এবং পাত্রে এক প্রকার সংযোগ আছে বলা যায়, এ সেইরূপ সংযোগ। পুষ্প এবং পাত্রমধ্যে ব্যবধান থাকিলেও পাত্রের বর্ণ বিকৃত হইতে পারে, ইহাও সেইরূপ। এ সংযোগ নিত্য নহে, দেখা যাইতেছে। সুতরাং তাহার উচ্ছেদ হইতে পারে। সেই সংযোগ উচ্ছেদ হইলেই, দুঃখের কারণ অপনীত হইল। অতএব এই সংযোগের উচ্ছিত্তিই দুঃখনিবারণের উপায়। সুতরাং তাহাই পুরুষার্থ। “যদ্বা তদ্বা তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থস্তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থঃ (৬, ৭০)।

 সাংখ্যের মত এই। যদি আত্মা শরীর হইতে পৃথক্ হয়, যদি আত্মাই সুখদুঃখভোগী হয়, যদি আত্মা দেহনাশের পরেও থাকে, যদি দেহ হইতে বিযুক্ত আত্মার সুখদুঃখাদি ভোগের সম্ভাবনা থাকে, তবে সাংখ্যদর্শনের এ সকল কথা যথার্থ বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু এই “যদি”গুলিন অনেক। আধুনিক পজিটিবিষ্ট এখনই বলিবেন,—

 ১ম। আত্মা শরীর হইতে পৃথক্ কিসে জানিতেছ? শারীর তত্ত্বে প্রতিপন্ন হইতেছে যে, শরীরই বা শরীরের অংশবিশেষই আত্মা।

 ২য়। আত্মাই যে সুখদুঃখভোগী, তাহারই বা প্রমাণ কি? প্রকৃতি সুখদুঃখভোগী নহে কেন?

 ৩য়। দেহনাশের পর যে আত্মা থাকিবে, তাহা ধর্ম্মপুস্তকে বলে; কিন্তু তদ্ভিন্ন অণুমাত্র প্রমাণ নাই। আত্মার নিত্যত্ব যদি মানিতে হয়, তবে ধর্মপুস্তকের আজ্ঞানুসারে; দর্শনশাস্ত্রের আজ্ঞানুসারে মানিব না।