পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOVV বিবিধ প্ৰবন্ধ-দ্বিতীয় ভাগ বলিয়া শিখাইয়া দেয়। সেই কথা আবার শত শত সম্বাদপত্রে প্রচারিত হইয়া শত শত ভিন্ন গ্রামে, ভিন্ন নগরে প্রচারিত, বিচারিত এবং অধীত হয় ; লক্ষ লক্ষ লোক সে কথায় শিক্ষিত হয়। এক একটা ভোজের নিমন্ত্রণেই স্বাদু খাদ্য চর্বণ করিতে করিতে ইউরোপীয় লোকে যে শিক্ষা প্রাপ্ত হয়, আমাদের তাহার কোন অনুভবই নাই। আমাদিগের দেশের যে সংবাদপত্র সকল আছে, তাহার দুৰ্দশার কথা ত পূর্বেই বলিয়াছি ; বক্তৃতা সকল ত লোকশিক্ষার দিক দিয়াও যায় না ; তাহার বহু কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ এই যে, তাহা কখনও দেশীয় ভাষায় উক্ত হয় না । অতি অল্প লোকে শুনে, অতি অল্প লোকে পড়ে, আর অল্প লোকে বুঝে ; আর বক্তৃতাগুলি অসার বলিয়া আরও অল্প লোকে তাহা হইতে শিক্ষাপ্ৰাপ্ত হয় । এক্ষণকার অবস্থা এইরূপ হইয়াছে বটে, কিন্তু চিরকাল যে এ দেশে লোকশিক্ষার উপায়ের অভাব ছিল, এমত নহে। লোকশিক্ষার উপায় না থাকিলে শাক্যসিংহ কি প্রকারে সমগ্ৰ ভারতবর্ষকে বৌদ্ধধৰ্ম্ম শিখাইলেন ? মনে করিয়া দেখ, বৌদ্ধ ধৰ্ম্মের কুট তর্কসকল বুঝিতে আমাদিগের আধুনিক দার্শনিকদিগের মস্তকের ঘৰ্ম্ম চরণকে আর্দ্র করে ; মক্ষমূলর যে তাহা বুঝিতে পারেন নাই, কলিকাতা রিবিউতে তাহার প্রমাণ আছে। সেই কূটতত্ত্বময়, নিৰ্ব্বাণবাদী, অহিংসাত্মা, দুৰ্ব্বোধ্য ধৰ্ম্ম, শাক্যসিংহ এবং তঁাতার শিষ্যগণ সমগ্ৰ ভারতবর্ষকে-গৃহস্থ, পরিব্রাজক, পণ্ডিত, মুখ, বিষয়ী, উদাসীন, ব্ৰাহ্মণ, শূদ্ৰ, সকলকে শিখাইয়াছিলেন। লোকশিক্ষার কি উপায় ছিল না ? শঙ্করাচাৰ্য্য সেই দৃঢ়বদ্ধমূল দিগ্নিজয়ী সাম্যময় বৌদ্ধধৰ্ম্ম বিলুপ্ত করিয়া আবার সমগ্ৰ ভারতবর্ষকে শৈবধৰ্ম্ম শিখাইলেন-লোকশিক্ষার কি উপায় ছিল না ? সে দিনও চৈতন্যদেব সমগ্ৰ উৎকল বৈষ্ণব করিয়া আসিয়াছেন। লোকশিক্ষার কি উপায় হয় না ? আবার এ দিকে দেখি, রামমোহন রায় হইতে কলেজের ছেলের দল পৰ্য্যন্ত সাড়ে তিন পুরুষ ব্ৰাহ্মধৰ্ম্ম ঘুষিতেছেন। কিন্তু লোকে ত শিখে না। লোকশিক্ষার উপায় ছিল, এখন আর নাই । একটা লোকশিক্ষার উপায়ের কথা বলি-সে দিনও ছিল—আজ আর নাই । কথকতার কথা বলিতেছি। গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, বেদী পিড়ীর উপর বসিয়া, ছেড়া তুলট, না দেখিবার মানসে সম্মুখে পাতিয়া, সুগন্ধি মল্লিকামালা শিরোপরে বেষ্টিত করিয়া, নাদুসূ নুদুস কালো কথক সীতার সতীত্ব, অৰ্জ্জুনের বীরধৰ্ম্ম, লক্ষ্মণের সত্যব্রত, ভীষ্মের ইন্দ্ৰিয়জয়, রাক্ষসীর প্ৰেমপ্রবাহ, দধীচির আত্মসমৰ্পণবিষয়ক সুসংস্কৃতের সদ্ব্যাখ্যা সুকণ্ঠে সদলঙ্কার সংযুক্ত করিয়া। আপামর সাধারণ সমক্ষে বিবৃত করিতেন। যে লাঙ্গল চাষে, যে তুলা পেজে, যে কাটুনা কাটে, যে ভাত পায় না পায়, সেও শিখিত—শিখিত যে ধৰ্ম্ম নিত্য, যে ধৰ্ম্ম দৈব, যে আত্মান্বেষণ অশ্রদ্ধেয়, যে পরের জন্য জীবন, যে ঈশ্বর আছেন, বিশ্ব সৃজন