পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰকৃত এবং অতিপ্ৰকৃত কাব্যরসের সামগ্ৰী মানুষের হৃদয় । যাহা মনুষ্যহীদয়ের অংশ, অথবা যাহা তাহার সঞ্চালক, তদ্ব্যতীত আর কিছুই কাব্যোপযোগী নহে। কিন্তু কখনও কখনও মহাকবির, যাহা অতিমানুষ, তাহারও বর্ণনায় প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন। তন্মধ্যে অধিকাংশই মনুষ্যচরিত্রচিত্রের আনুষঙ্গিক মাত্র । মহাভারত, ইলিয়দ প্ৰভৃতি প্ৰাচীন কাব্যসকল, এই প্ৰকার পাথিব নায়ক নায়িকার চিত্রানুষঙ্গিক দেবচরিত্র বর্ণনায় পরিপূর্ণ। দেবচরিত্র বর্ণনায় রসহানির বিশেষ কারণ এই যে, যাহা মনুষ্যচরিত্রানুকারী নহে, তাহার সঙ্গে মনুষ্য লেখক বা মনুষ্য পাঠকের সহৃদয়ত জন্মিতে পারে না। যদি আমরা কোথাও পড়ি যে, কোন মনুষ্য যমুনার এক বহুজলবিশিষ্ট হ্রদমধ্যে নিমগ্ন হইয়া অজগর সর্প কর্তৃক জলমধ্যে আক্রান্ত হইয়াছে, তবে আমাদিগের মনে ভয়সঞ্চার হয় ; আমাদিগের জানা আছে যে, এমন বিপদাপন্ন মনুষ্যের মৃত্যুরই সম্ভাবনা ; অতএব তাহার মৃত্যুর আশঙ্কায় আমরা ভীত ও দুঃখিত হই; কবির অভিপ্রেত রস অবতারিত হয়, তঁহার যত্নের সফলতা হয় । কিন্তু যদি আমরা পূর্ব হইতে জানিয়া থাকি যে, নিমগ্ন মনুষ্য বস্তুতঃ মনুস্য নহে, দেবপ্রকৃত, জল বা সৰ্পের শক্তির অধীন নহে, ইচ্ছাময় এবং সর্বশক্তিমান, তখন আর আমাদের ভয় বা কুতুহল থাকে না ; কেন না, আমরা আগেই জানি যে, এই অজেয়, অবিনশ্বর পুরুষ এখনই কালিয় দমন করিয়া জল হইতে পুনরুত্থান করিবেন। এমত অবস্থাতেও যে পূর্বকবিগণ দৈব বা অতিমানুষ চরিত্র সৃষ্ট করিয়া লোকরঞ্জনে সক্ষম হইয়াছেন, তাহার একটি বিশেষ কারণ আছে। তঁহারা দেবচরিত্রকে মনুষ্যচরিত্রানুকৃত করিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন ; সুতরাং সে সকলের সঙ্গে পাঠক বা শ্রোতার সহৃদয়তার অভাব হয় না। মনুষ্যগণ যে সকল রাগদ্বেষাদির বশীভুত ; মনুষ্য যে সকল সুখের অভিলাষী, দুঃখের অপ্রিয় ; মনুষ্য যে সকল আশায় লুব্ধ, সৌন্দৰ্য্যে মুগ্ধ, অনুতাপে তপ্ত, এই মনুষ্যপ্রকৃত দেবতারাও তাই। শ্ৰীকৃষ্ণ, জগদীশ্বরের আংশিক বা সম্পূর্ণ অবতারস্বরূপ কল্পিত হইলেও মনুষ্যের ন্যায় মানবধৰ্ম্মাবলম্বী। মানবচরিত্রগত এমন একটি উৎকৃষ্ট মনোবৃত্তি নাই যে, তাহা ভাগবতকারকৃত শ্ৰীকৃষ্ণচরিত্রে অঙ্কিত হয় নাই। এই মানুষিক চরিত্রের উপর অতিমানুষ বল এবং বুদ্ধির সংযোগে চিত্রের কেবল মানোহারিত্বে বৃদ্ধি হইয়াছে ; কেন না, কবি মানুষিক বলবুদ্ধিসৌন্দৰ্য্যের চরমোৎকর্ষ সৃজন করিয়াছেন। কাব্যে অতিপ্ৰকৃতের সংস্থানের উদ্দেশ্য এবং উপকার এই ; এবং তাহার নিয়ম এই যে, যাহা প্ৰকৃত, তাহা যে সকল নিয়মের অধীন, কবির সৃষ্টি অতিপ্ৰকৃতও সেই সকল নিয়মের অধীন হওয়া উচিত ।