পাতা:বিবিধ কথা.djvu/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জাতির জীবন ও সাহিত্য

করি নাই। তথাপি যেটুকু জ্ঞান জন্মিয়াছে, তাহাতে সে যুগের বাঙালীসমাজের একটা বৃহৎ রেখাচিত্র আমার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে সর্ব্বদা বিদ্যমান আছে। সে যুগের বাঙালী-জীবনের সেই শাক্ত ও বৈষ্ণব সাধনার যুগ্মধারার মধ্যে জাতির ধাতুপ্রকৃতির যে পরিচয় পাই, তাহাতে বিস্ময় বোধ করি। স্পষ্ট দেখিতে পাই, শাস্ত্র ও সংহিতার দ্বারা দৃঢ়বন্ধ এক সমাজ—সেই সমাজে অতিশয় স্বাস্থ্যবান ও দীর্ঘায়ু পুরুষপরম্পরা; এক দিকে ভক্তিসাধনার আত্মবিলোপ, অপর দিকে শক্তিসাধনার বজ্রকঠিন মনোবৃত্তি; আচার-অনুষ্ঠানের নাগপাশে যেমন আত্মশাসন—সমাজের হিতার্থে আত্মসংকোচ, তেমনই, ব্যক্তিগত ভাবসাধনার পূর্ণ স্বাধীনতা। সে যুগের রাষ্ট্রীয় অধীনতার মধ্যেই স্বধর্ম্ম বজায় রাখিবার জন্য এ জাতির সেই আগ্রহ—এবং তাহার উপায় উদ্ভাবনে ধর্ম্মে ও সমাজে, ভাবে ও চিন্তায়, প্রতিভা ও মনীষার সেই অভাবনীয় আকস্মিক স্ফুরণ— সে কাহিনী সম্পূর্ণ জ্ঞানগোচর না হইলেও আমি তাহাকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করি; উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর নূতনতর আদর্শে দীক্ষিত ও প্রভাবিত হইলেও, আমার চিত্ত সেই পিতৃ-পিতামহগণের মহিমা স্মরণ করিয়া কৃতার্থ হয়। আমি রঘুনাথ, রঘুনন্দন, শ্রীচৈতন্য ও কৃষ্ণানন্দ— সকলের স্মৃতিকে সমভাবে অর্চ্চনা করি। জাতির অতীতকে যে শ্রদ্ধাসহকারে অধ্যয়ন করে নাই, সে আত্মজ্ঞান লাভ করে নাই— তাহার আত্মা জাতিভ্রষ্ট হইয়াই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছে। বিশ্বমানববাদের কোন অর্থ বা মূল্যই নাই, যদি তাহার মূলে জাতিধর্ম্মেরও সুস্থ প্রেরণা না থাকে। যে সমাজের অতীত নাই, সে সমাজ কালস্রোতে শৈবালের মত; তাহার বর্ত্তমানই আছে, ভবিষ্যৎ নাই।


 পূর্ব্বে বলিয়াছি, আমার চিত্তবিকাশ হইয়াছে উনবিংশ শতাব্দীর