૨૨૨ বিবিধ কথা তাহার নিকট একমাত্র সত্য । জ্ঞানের চর্চাতেও সে ভাবের অধীন। এজন্য জ্ঞানমাত্রই তাহার ব্যবহারিক জীবনে ফলপ্রস্থ হয় না। জ্ঞানচর্চায়, তর্কবিচারের মস্তিষ্কচালনায়, সে যে আনন্দ পায় তাহা একটা বিলাস মাত্ৰ—সে বস্তু তাহার প্রাণ বা কামনা-বাসনার নিয়ামক নয়, সেখানে সে যুক্তি অপেক্ষা কুযুক্তি, ন্যায়নিষ্ঠ অপেক্ষ মমত্ববোধ, নিয়ম অপেক্ষ অনিয়মের পক্ষপাতী। এই প্রবৃত্তিকে সে এতদিন গোপনে তৃপ্ত করিয়। আসিতেছিল, প্রবল ব্রাহ্মণ্য-শাসনের মধ্যেও সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুপ খনন করিয়া তাহার হৃদয়ের পিপাসা মিটাইতেছিল । ইংরেজ শাসন ও ইংরেজী শিক্ষা এই প্রবৃত্তিকে দুই দিক দিয়া আঘাত করিল। ইংরেজের শাসন-ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজের বন্ধন ভিতরে ভিতরে শিথিল হইয়া আসিল, তাহাতে বাঙালীর প্রকৃতগত ভাব-স্বাধীনতা প্রশ্রয় পাইল । অপর দিকে ইংরেজী শিক্ষার মধ্য দিয়া যে যুক্তিবাদ, এবং খ্ৰীষ্টিয়ান ধৰ্ম্ম ও নীতির প্রভাবে—যে চারিত্র্যের আদর্শ—তাহার মনকে গভীরভাবে নাড় দিল, তাহার ফলে তাহার এতদিনের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার আবার নূতন করিয়া জাগ্রত ও উদ্যত হইয়া উঠিল—এই নূতনকে পুরাতনের অধীন করিতে চাহিল। গত এক শত বৎসর ধরিয়া বাঙালীর ভাব-জীবনের ইতিহাসে —ধৰ্ম্ম ও সমাজ সংস্কারে এবং নব সাহিত্য-স্বষ্টির প্রেরণায়—তাহার যে অন্তর-বিপ্লবের পরিচয় পাওয়া যায়, সেই নবজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাণপণ প্রয়াসের মধ্যে এই দুই বিপরীত প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব ফুটিয়া উঠিয়াছে, এবং মনে হয়, পরিশেষে এই দ্বন্দ্বে অবসন্ন হইয় সে হাল ছাড়িয়া দিয়াছে।
