পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/৩৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভয়ের অনিদ্রা অভয়ের সারারীত্রি ঘুম হইল না। শত চেষ্টা করিয়াও সে তাহার চক্ষু নিমীলিত করিতে পারিল না। সেই যে আচমকা কিসের যেন শব্দে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল তার পর আর কিছুতেই সে ঘুমাইতে পারিল না। চক্ষু যেন তাহার ঠিকরাইরা বাহির হইবার উপক্রম হইল। বেশ শাস্তিতে সে ঘুমাইতেছিল, অকস্মাৎ কে যেন তাহার স্বারে করাঘাত করিয়া গেল। সেই শব্দে অভয়ের সুপ্ত চেতনা জাগিয়া উঠিল। অভয় ধীরে ধীরে তাহার শয্যার উপর উঠিয় বসিল, ধীরে ধীরে ক্ষীণপ্রায় হারিকেনটি উজ্জ্বল করিয়া দিল, ধীরে ধীরে চারিদিকে সাবধানে চাহিয়া দেখিল । না, কোথাও এতটুকু অসামঞ্জস্য ঘটে নাই। যেখানকার জিনিসটি যেমন ছিল তাহ ঠিক সেখানেই আছে, এতটুকু নডে নাই । অভয় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাচিল । ভয় তাহার নিশ্চয় অহেতুক। সে প্রথমে ভাবিয়াছিল হয়তো ডাকাত পড়িয়াছে, কিন্তু পরক্ষণেই স্মরণ হইল ইহা কলিকাতা, ডাকাত পড়িবার সম্ভাবনা নাই আদৌ। তার পর মনে পডিল হয়তে চোর পডিয়াছে । অনেকক্ষণ কান খাডা করিয়া রহিল । চোরের আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। তবে কিসের এই বিকট শব্দ ? অভয় ভাবিয়া ভাবিয়া আকুল হইল । মুহূৰ্ত্তে তাহার পাশের শূন্ত বিছানায় নজর পডিল। সাতদিন আগে ঐ শয্যা পূর্ণ ছিল। সাতদিন আগে তাহার এ গৃহ এমন মহাশূন্তত প্রকট করিয়া খ খ করিত না । মনে পডিল বেচারা বকুলেব কথা—তাহার সহধৰ্ম্মিণী, তাহার স্ত্রী, অগ্নিসাক্ষী করিয়া যাহাকে গৃহলক্ষ্মীরূপে বরণ করিয়া লইয়াছিল । তিন বছর পূৰ্ব্বে এই শ্রাবণের এক শুভলগ্নে বকুলকে সে সগোত্রের গণ্ডির মধ্যে টানিয়া আনিয়াছিল। সেদিনও আকাশে এমনি করিয়া পূর্ণিমার চাদ উঠিয়াছিল। তখন তাহার মা ছিলেন । দিন বেশ মুখেই কাটিতেছিল। তার পর একদা পরপার হইতে মার ডাক পডিল। বকুল নিপুণ হস্তে সংসারের হাল টানিয়া ধরিল। অভয় তাহার পানে তন্ময় হইয়া চাহিয়া রহিল। মাতার অভাব বকুলকে দিয়া পূরণ করা হইল। প্রখম প্রথম বকুলকে অবশুই বেগ পাইতে হইয়াছিল ; কিন্তু অচিরেই সে অভ্যস্ত হইয়া গেল । সংসারের হিসাবপত্র হইতে আরম্ভ করিয়া রান্না পৰ্য্যস্ত তাহাকে নিজ হন্তে করিতে হইত। কালক্রমে স্বকুল স্বামীর বিরাট বহুবিস্তৃত সংসারের সহিত এমনভাবে জড়িত হইয়া গেল যে তাহার অভাব একদিনও সহ করা যাইত না। বাপের বাড়ী যাইবার ফুরসত সে পাইত না। ভোর হইতে উঠিয়া গভীর রাত্রি পর্য্যস্ত কৰ্ম্মে তাহার বিশ্রাম ছিল না। কলের পুতুলের স্থায় সে অক্লান্ত কৰ্ম্ম করিয়া যাইত ৷ একবেলা তাহার অসুখ করিলে সংসার অচলপ্রায় হইয়া যাইত। ছেলেমেয়েদের পেট ভরিয় খাওয়া হুইত না । অতিথি-অভ্যাগত ফিরিয়া যাইত। খাদ্যদ্রব্য এমনই অখাদ্য হুইত যে কাহারও মুখে তুলিবার রুচি হুইত না । পাশের বাড়ীর চাপ একা ম্যাহেবেড়াইতে আসিয়াছিল। সে বকুলকে দেখিয়া বলিল, দিদির চেহারা কি বিত্র হয়ে গেল ! 尊