পাতা:বিভূতি রচনাবলী (একাদশ খণ্ড).djvu/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

l/e প্রতীক। তাই যত দিন যায়, তত শশাঙ্কর মনে সন্দেহ বাড়ে, সত্যি কি তার মত একজন প্রৌঢ়কে ওই তরুণী পান্না ভালবাসতে পারে ? এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় তার মন হয়ত সর্বদা "দোলাচলচিত্ত", এমন কি পান্না যখন ওর জন্তে ঘরদোর ছেড়ে আলাদা বাসা ভাড়া করলে তখনো সন্দেহ যায় না । ওই কিশোরী তরুণী যেন এক পরমপ্রেমের প্রতীক। মানুষের অস্তরে যেমন ঈশ্বরচেতনা ও ভগবৎপ্রেম, ধীরে ধীরে জাগ্রত হয়ে পূর্ণতার মধ্যে এসে পড়লেও তার সন্দেহ যেতে চায় না, মন বলে সত্যি কি তাকে পেয়েছি । সর্বস্ব সমৰ্পন করেও মন নিশ্চিন্ত হ’তে পারে না । ‘পারে না বলেই সাধনার প্রয়োজন। ক্রমশ সেই দিকে মনকে একনিষ্ঠ করে তোলা ! পান্ন খেমটাউলী, শশাঙ্কর জন্যে সব কিছু ত্যাগ করেও তাই আশঙ্কা দূর হয় না, ভাবে পাছে তাকে ফেলে একদিন চলে যায়। নাচের আসরে শশাঙ্ককে সে বসে থাকতে বলে।—“তুমি কিন্তু উঠে না। তাহলে আমার নাচ খারাপ হয়ে যাবে। নীলি কি বলেচে জানো 7 বলেচে তোমার জন্যেই নাকি আমার নাচ ভাল হচ্ছে।” অর্থাৎ দেববিগ্রহকে সামনে না দেখলে যেমন পূজায় মন বসে না, এও তেমনি । শশাঙ্ককে বুঝি পান্না তার হৃদয়দেবতার আসনে স্থাপিত করেছিল। অথচ পান্নার দিকে চেয়ে চেয়ে এক-একদিন শশাঙ্কর মনে হয়—“কোন স্বর্গে আমায় রেখেচে ও ? ওকে পেয়ে দুনিয়া ভুল হয়ে গিয়েচে আমার। পূৰ্ব্ব আশ্রমের কথা কিছুই মনে নেই। স্বরবালা-টুরবালা কোথায় তলিয়ে গিয়েচে ।” পান্না নিজে উপার্জন করে শশাঙ্ককে খাওয়াবে চিরদিন, এই কথাটা শুনে পান্নার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে, সন্দেহ দূর হয়ে যায়। মনে হয় –“পাল্লা আমাকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই। ভাল না বাসলে ও এমন বলতে পারত না । আমার বয়স হয়েচে, একটি ষোড়শী স্বন্দরী কিশোরী আমাকে এমন ভালবাসবে, এ আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত। একবার বিশ্বাস হয়, একবার হয় না।” আবার সেইদিনই নির্জন পার্কে বসে, একা তার কথা ভাবতে ভাবতে মনে হয়— “পান্না আমাকে ভালোবাসে, চালোবাসে, ভালোবাসে। --” এই কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে শশাঙ্কর দেহে অদ্ভুত এক শিহরণ ও উত্তেজনার স্বষ্টি হয়। —“শুধু ভেবেই আনন্দ। এত আনন্দ যে আছে চিস্তার মধ্যে, এত পুলক, এত শিহরণ, এত নেশা—একথাই কি আগে জানতাম ? যেন ভাঙ, খাওয়ার নেশার মত রঙীন নেশাতে মশগুল হয়ে বলে আছি ! জীবনে এরকম নেশা আসে চিন্তা থেকে তাই বা কি আগে জানতাম !" অর্থাৎ ঈশ্বরের চিস্তার মধ্যে যে পরম আনন্দ আছে এ সেই অনুভূতির ইঙ্গিত। তাই এর পরেই শশাঙ্কর মনে হয়—“স্বরবালার সঙ্গে এতদিনের ঘরকন্ন আমার ব্যর্থ হয়ে গিয়েচে । ভালবাসা কি জিনিস ও আমাকে শেখায় নি ! যদি কখনো না জানতাম এ জিনিস, জীবনের একটা মস্ত বড় রসের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতাম। স্বরবালার চন্তা আমাকে কখনো নেশা লাগায় নি ।” ū