পাতা:বিভূতি রচনাবলী (একাদশ খণ্ড).djvu/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্প নয় সেদিন হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে ঢুকে দেখি কামরাতে আদৌ ভিড় নেই। সকালের ট্রেনে কামরা অনেকটা খালি পাওয়া যায় বটে। নিজের ইচ্ছামত বিছানা পেতে নিয়ে বসেছি, এমন সময় একটি বৃদ্ধ মুসলমান একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঢুকল এবং আমার বিছানার অদূরে বসল। O খবরের কাগজ পড়বার ফাকে খবরের কাগজের ওপর দিয়ে ওদের চেয়ে দেখলাম। এমন একটি দৃশ্ব আমার চোথে কখনও পড়েছে কিনা সন্দেহ । বৃদ্ধ মুসলমান পরম যত্নে শিশুটিকে কোলের মধ্যে আঁকড়ে রেখেছে। কিন্তু শিশুটির চেহারা দেখ মনে হল, বেশিদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস ওকে ভোগ করতে হবে না । শুধু কথানি হাড়ের ওপর চামড় দিয়ে ঢাকা, মাংস আদৌ নেই বললেই হয়, সেইজন্যে ষ্টাটুর ও পায়ের নীচের চামড়া কুঁচকে জড়ো হয়ে এসেছে। মাথার চুল উঠে যাচ্ছে, মাথার চারিদিকে বড় বড় সাত-আটটি ঘা। ওষুধের তুলো লেপটানো রয়েছে । এ ক্ষেত্রে আমরা যেমন করে থাকি, তাই করলাম । কড়া স্বরে বললাম—সরে বস না বাপু, একেবারে ঘাড়ের ওপরে কেন ! গাড়ীতে যথেষ্ট জায়গা তো পড়ে রয়েছে। বৃদ্ধ মুসলমানটি আমাকে বলতে পারত অনায়াসেই—কেন মশাই, আপনার বিছানাতে আমি বসি নি তো। তফাতেই বসে আছি, তবে সরে বসতে বলছেন কেন ? টিকিট করে আপনিও যাচ্ছেন, আমিও যাচ্ছি। আপনি সরে বসতে বলবার কে ? কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেমন সাধারণত হয়ে থাকে—-লোকটি সরে বসল। আমি আবার আমার খবরের কাগজে মন দিলাম । একবার গাড়ীতে ফেরিওয়াল উঠে বিস্কুট ফেরি করতে লাগল। মুসলমানটি শিশুকে দুখানা বিস্কুট কিনে দিলে। আর একবার তাকে চানাচুর কিনে দিলে। আমার মনে হল আমার নিজের ছেলে হলে তাকে এই রুগণ অবস্থায় আমি কি বিস্কুট-চানাচুর খাওয়াতাম ? কিন্তু মুখে কোন কথা ওকে বলি নি । যা খুশি করুক, আমার বলবার দরকার কি ? এক একবার চেয়ে দেখি, আমার বিছানার কাছে এসে বসল কিনা। কি কুত্ৰ কদাকার হয়েছে দেখতে ছোট ছেলেটা ! ইতিমধ্যেই অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে। গাড়ীতেও লোকজনের যথেষ্ট ভিড় হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ আমার কানে গেল একটি ছোট মেয়ের স্নেহময় স্বরে কে যেন বলছে—এ বিস্কুটগুলো তেমন মিষ্টি নয় বলে খোকা খাচ্ছিল না—এখন দেখ কেমন খাচ্ছে। নাম, দেই, কেমন হাত দিয়ে মুখে তুলে কুটুর কুটুর কাটছে— এমন ধরনের কথা এবং এমন ধরনের স্বর আমার কাছে অত্যন্ত পরিচিত বলেই প্রথম ওই কথাটা আমার অন্যমনস্ক মনকে আকৃষ্ট করে ।