পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ b"ぶ) —গোটাকুড়ি দাও গিয়ে এখন। কাল সকালেই আমি তা হলে চলে যাই ডাক্তার श्रांनाङ —তা হলে কাল সকালে যাবার সময় আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি। ওখান দিয়েই তো পথ—কেমন তো ? ছোটকাকীমা এই সময় এলেন । শৈলদিকে দেখে বললেন–জিতুর মাকে নিয়ে বেজায় মুশকিল হয়েচে ভাই—ওরা ছেলেমানুষ, কি বা বোঝে—নিতু এখনও তো এল না। হঠাৎ চার পাচ দিনের জরে যে মানুষ এমন হয়ে পড়বে তা কি ক’রেই বা জানবো । তবুও তো জিতু কোথা থেকে ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল তাই রক্ষে । রাতে জ্যাঠাইমাও এসে খানিকটা বসে রইলেন। অনেক রাত্রে সবাই চলে গেল, আমি সীতাকে বললাম—তুই ঘুমিয়ে নে সীতা। আমি জেগে থাকি। রাতে কোন ভয় নেই। সকাল বেলা আটট-নটার পর থেকে মা'র অবস্থা খুব খারাপ হ’ল। দশটার পর দাদা এল—সঙ্গে বৌদিদি ও দাদার খোকা। বৌদিদিকে প্রথম দেখেই মনে হ’ল শাস্ত, সরল, সহিষ্ণু মেয়ে। তবে খুব বুদ্ধিমতী নয়, একটু অগোছালে, আনাড়ি ধরনের। নিতান্ত পাড়াগায়ের মেয়ে, বাইরে কোথাও বেরোয়নি বিশেষ, এই বোধ হয় প্রথম, কিছু তেমন দেখেও নি। গরম জলের বোতল পায়ে সেঁক করতে হবে শুনে ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিপন্ন মুখে সীতার দিকে চেয়ে রইল। কাপড়-চোপড় পরবার ধরনও অগোছালো—আজকালকার মত নয়। বৌদিদি যেম বনে-ফোটা শুভ্র কাঠমল্লিকা ফুল, তুলে এনে তোড়া বেঁধে ফুলের দোকানে সাজিয়ে রাখবার জিনিস নয়। আর একেবারে অদ্ভুত ধরনের মেয়েলী, ওর সবটুকুই নারীত্বের কমনীয়ত মাখানে । সীতা আমায় আড়ালে বললে—চমৎকার বৌদি হয়েচে, ছোড়দা । আহা, মা যদি একটিবারও চোখ মেলে দেখতেন । আমাদের কপাল ! বেলা তিনটের সময় মা মারা গেলেন। যে মায়ের কথা তেমন ক’রে কোন দিন ভাবি নি, আমাদের কাজকর্শ্বে, উদ্যমে, আশায়, আকাজক্ষয়, উচ্চাভিলাষে মায়ের কোন স্থান ছিল না, সবাই মিলে যাকে উপেক্ষ ক'রে করে এসেচি এত দিন—আজ সেই মা কত দূরে কোথায় চলে গেল—সেই মায়ের অভাবে হঠাৎ আমরা অনুভব করলাম অনেকখানি খালি হয়ে গিয়েচে জীবনের। ঘরের মধ্যে যেমন প্রকাণ্ড ঘরজোড়া খাট থাকে, আজন্ম তার ওপর শুয়েচি, বলেচি, খেলেচি, ঘুমিয়েচি, সৰ্ব্বদা কে ভাবে তার অস্তিত্ব, আছে তো আছে। হঠাৎ একদিন খাটখানা ঘরে নেই—ঘরের পরিচিত চেহারা একেবারে বদলে গিয়েচে—সে ঘরই যেন নয়, একদিন সে ঘরের নিবিড় সুপরিচিত নিজস্বতা কোথায় হারিয়ে গেল, তখন বোঝা যায় ঘরের কতখানি জায়গা জুড়ে কি গভীর আত্মীয়তায় ওর সঙ্গে আবদ্ধ ছিল সেই চিরপরিচিত একঘেয়ে সেকেলে খাটখানা—ঘরের বিরাট ফাকা আর কিছু দিয়েই পূর্ণ হবার নয়। সীতার ধৈৰ্য্যের বাধ এবার ভাঙলো। সে ছোট মেয়ের মত কেঁদে আবদার ক’রে যেন মাকে জড়িয়ে থাকতে চায়। মা আর সে দুজনে মিলে এই সংসারে সকালে-সন্ধ্যায় ভূ-বেলা খেটে দুঃখের মধ্যে দিয়ে পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসেছিল—সে-সব দিনের দুঃখের সঙ্গিনী হিসাবে মা আমাদের চেয়েও ওর কাছে বেশী আপন, বেশী ঘনিষ্ঠ—অভাগী এত দিনে সত্যি সত্যি নিঃসঙ্গ হ’ল সংসারে। ওর স্বামী যে ওর কেউ নয়, সে আমার বুঝতে দেরি হয় নি এতটুকু। কিন্তু ও হয়ত এখনও তা বোঝেনি।