পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ásbo বিভূতি-রচনাবলী চলে, পুরোনো পাতা ঝরে পড়ে, নতুন গান পুরোনো হয়ে যায়। গ্রহে গ্রহে, নক্ষত্রে নক্ষত্রে কত দৃশু-অদৃত লোকে, কত অজানা জীবজগতেও এরকম বেদন, দীনতা দুঃখ । দুরের সে-সব অজানালোকে ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদী দীর্ঘ বটগাছের ছায়ার বয়ে যায়, তাদের শাস্ত বন-বীথির মূলে প্রিয়জনের, বহুদিন-হারা প্রিয়জনের কথা ভাবে—নদীর স্রোতে শেওলা-দাম-ভাসা জলে অনস্তের স্বপ্ন দেখে-“যে অনন্ত তার চারধার ঘিরে আছে সব সময়, তার নিঃশ্বাসে, তার বুকের অদম্য প্রাণস্রোতে, তার মনের খুশীতে, নাক্ষত্রিক শূন্তপারের মিটুমিটে তারার আলোয়। দুরের ওই দিথলয় যেখানে চুপি চুপি পৃথিবীর পানে মুখ নামিয়ে কথা কইছে, শুষ্ঠপথে অদৃশ্ব চরণে দেবদেবীরা যেন এই সন্ধ্যায় ওখানে নেমে আসেন। যখন নদীজল শেষরৌদ্রে চিক্‌ চিক্‌ করে, কুলে কূলে অন্ধকার ফিরে আসে, পানকলস শেওলার ফুল কালো জলে সন্ধ্যার ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়—তখনই । আমার মনে সব ওলট-পালট হয়ে গেল, এমন এক দেবতার ছায়া মনে নামে—যেন জ্যাঠাইমাদের শালগ্রামশিলার চেয়ে বড়, আটঘরার বটতলার সেই পাথরের প্রাচীন মূৰ্ত্তিটির চেয়ে বড়, মহাপুরুষ খ্ৰীষ্টের চেয়েও বড়–চক্রবালরেখায় দূরের স্বপ্নরূপে সেই দেবতারই ছায়, এই বিশাল প্রাস্তরে মান সন্ধ্যার রূপে মাথার ওপর উড়ে-যাওয়া বালিহাসের সাই সঁাই পাখার ডাকে। সেই দেবতা আমায় পথ দেখিয়ে দিন । আমি যা হারিয়েছি তা আর চাই নে, আমি চাই আজকার সন্ধ্যার মত আনন্দ, এবং যে নতুন দৃষ্টিতে এই এক মুহূর্তের জন্তে গজৎটাকে দেখেছি সে দৃষ্টি হারিয়ে যাবে জানি, সে আনন্দ জীবনে অক্ষয় হবে না জানি–কিন্তু আর একবারও যেন অন্ততঃ তারা আসে আমার জীবনে । | >> | পরদিন দুপুরে সন্ধান মিলল ক্রোশ-চারেক দূরে দ্বারবাসিনী গ্রামে একটি প্রসিদ্ধ আখড়াবাড়ি আছে, সেখানে মাঝে মাঝে ভাল ভাল বৈষ্ণব সাধু আসেন। গায়ের বাইরে আখড়াবাড়ি, সেখানে থাকবার জায়গাও মেলে । সন্ধ্যার সামান্ত আগে দ্বারবাসিনীর আখড়াবাড়িতে পৌঁছলাম। গ্রামের প্রান্তে একটা পুকুরের ধারে অনেকগুলো গাছপালা—ছায়াশূন্ত, কাকরভর, উষর ধুধু মাঠের মধ্যে এক জায়গায় টলটলে স্বচ্ছ জলে ভরা পুকুর । পুকুরপাড়ে বকুল, বেল, অশোক, তমাল, নিম গাছের ছায়াভর ঘনকুঞ্জ, দু-চারটে পাখীর সান্ধ্যকাকলি—মরুর বুকে শু্যামল মরুদ্বীপের মত মনে হ’ল। এ অঞ্চলে এর নাম লোচনদাসের আখড়া। আমি যেতেই একজন প্রৌঢ় বৈষ্ণব, গলায় তুলসীর মালা, পরনে মোট তসরের বহিৰ্ব্বাস, উঠে এসে জিজ্ঞেস করলে,—কোথেকে আসা হচ্চে বাবুর ? তারপর তালপাতার ছোট চাটাই পেতে দিলে বসতে, হাত-মুখ ধোয়ার জল নিজেই এনে দিলে। গোলমত উঠোনের চারিধারে রাঙা মাটির দেওয়াল-তোলা ঘর, সব ঘরের দাওয়াতেই দুটি-তিনটি বৈষ্ণব, খুব সম্ভবতঃ আমার মতই পথিক, রাত্রের জঙ্ক আশ্রয় নিয়েছে। সন্ধ্যার পরে আমি তালপাতার চাটাইয়ে বসে একটি বৃদ্ধ বৈষ্ণবের একতারা বাজনা ও গান শুনচি—এমন সময় একটি মেয়ে আমার উঠোনে এসে জিজ্ঞেস করলে—আপনি রাত্তিরে কি খাবেন—? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-আমায় বলচেন ? মেয়েটি শান্ত স্বরে বললে—স্থ্যা। রাত্তিরে কি ভাত খান ? .. আমি থভমত খেয়ে বললাম—যা হয়, ভাতই থাবো । আপনাদের যাতে সুবিধে ।